August 29, 2021

অমিত চক্রবর্তী

 বাবা


আমি আক্রোশে ভেঙেছি তাঁর একমাত্র ছবি

কেন তুমি নিয়ে যাওনি মাঠে, পেলে যখন খেলতে এল

ইডেনে? কেন তুমি নিজস্ব পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত, চলে গেলে

ধ্বনি শুনে স্বর্গের গেটে, না কি লোভে পড়ে পারিজাত ফুলের?

কেন তুমি বুকে তুলে নাওনি ধড়

চমকে ফেলে দিলে মুন্ড ভুমিতে ধুলোয়

মেঘকালো সেই আজগুবী সন্ধ্যায়?

ফিরে এসো বাবা, আমি তো এখন তোমারই বয়সী, কবে থেকে

ভাঙছি তোমার ছবি, কেন তুমি একটুও অস্থির নও,

চলে গেছ কতদিন আগে, ছ’ বছর বয়েসে, বাবা,

এখন স্বপ্নে এলে তো আর চিনতেও পারব না। 



গুচ্ছ কবিতা।।তৈমুর খান ।।

সমস্ত যুদ্ধের পর 


অনেক মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকা 

হেসে ওঠে মাঝরাতে 

কোনও পিয়ানোর সুরে 


খোলাচুল উড়ে আসে তার 

বুকের ভেতর থেকে জ্যোৎস্নার ফণা 

দেখি দেখি চাঁদ গলে গেছে সারা দেহে 


সমস্ত যুগের রক্ত বয়ে গেছে 

এই পথ প্রগলভ অতীত 

তবুও নিহিত এক মর্মের জানালা 


চেতনা ফিরে পায় মৎস্যমুখী মেয়ে 

আকাশে গহনে জলে লেখে আলপনা 

বিন্দু বিন্দু বেঁচে ওঠা ঘুম 


ঈশ্বর

লীলাকে ডাকিনি কাছে 

শরীরই ঈশ্বর হয়ে আমার শরীরে শুয়ে আছে


নিজস্ব ফাঁকা আস্তাবলে আজ কোনও ঘোড়া নেই 

সব ঘোড়া অশ্বিনীকুমার হয়ে গেছে 


প্রাচীন পৃথিবীর রহস্য-আলোয় জল খেতে এসে দেখি 

সব ঝরনায় আমারই ঈশ্বর হেসে ওঠে…. 


বাসরবাগান


সব ফুল ফুটবার আগেই 

সৌরভ এসে উপস্থিত হয়েছে বাগানে 

ফুলের দিকে তাকালেই 

                      জড়িয়ে ধরছে হাসি 

                             স্বপ্নের সেই পেলব পাপড়িগুলি 

এক একটি ইংগিত ডাকছে আমাকে 

আগাছার ভিড় ঠেলে 

লতানো গাছের বাহু ঠেলে

                         এগিয়ে চলেছি 

আজ ঘাসে ঘাসে শয্যা পাতা আছে 

পাতায় পাতায় আশ্চর্য কাহিনি... 


সৌজন্যে 


কোথাও কোথাও পরমজনেরা থাকে 

                                                       দেখা হয় 

                         তাদের সৌজন্যে আহ্লাদ পাই আমি 

দুঃখের ঘষা ঘষা দাগগুলি 

                                                   মুছে ফেলি 

                আর ক্ষত স্থান জুড়ে রক্তজবা ফোটাই                                 

শোকের ঝরনার তীরে 

                       কুসুম কুসুম সকাল হলে তার

           আনন্দের প্রতীক্ষায় রোদ খুঁটে খাই 


জলজ


নিজেকে ব্যঞ্জনা ছাড়াই তোমার কাছে উপস্থিত করি 

আমাকে স্পর্শ করো —


বয়স কি গোখরো সাপ ছুঁলেই ছোবল দেবে ? 


শ্যাওলা সরিয়ে দ্যাখো, স্নিগ্ধ জলের তলায় 

আমারই নিভৃত অঙ্কুরোদ্গম.... 


নষ্ট সিনেমা 


করতলে নদীর বিয়ানো চরাচর 

নৌকা চিহ্ন, বাঁশিব় জীবাশ্ম 

আর খাঁ খাঁ শূন্য বিস্ময় 


বিমূঢ় যুগের ছবি 

ক্যামেরায় সাঁতার দিচ্ছে 


বিকল্প শিকারি এসে শুরু করছে অন্ধবিপ্লব 



কবি পরিচিতি : জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে। 

পিতা ও মাতা :জিকির খান ও নাওরাতুন। 

পড়াশোনা :বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি প্রাপ্তি। 

পেশা : উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক । 

প্রকাশিত কাব্য : কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) ইত্যাদি। 

পুরস্কার : কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার ও দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, কবি আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার ইত্যাদি ।

ঠিকানা : রামরামপুর (শান্তিপাড়া), রামপুরহাট, বীরভূম, পিন ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।










          

সব্যসাচী পণ্ডা

 বিদ্ধ

    

আমার বুকের মধ্যে বিঁধে আছে ছুরি আমূল 

রক্তে ভেসে যাচ্ছে যাক... হৃদি

আমি তুলবো না তাকে কিছুতেই

যতদিন না হে পৃথিবী তোমায় সুস্থ হতে দেখি।




মীরা মুখোপাধ্যায়

 রঙ 


মৃত মানুষের সাথে আজকাল দেখা হয় প্রায়ই, স্বপ্নে

কারো কাঁধে হাত রেখে হাটি

কারো সাথে গল্প করি অবলীলাক্রমে

জিজ্ঞাসাও করে ফেলি কখনও কখনও

এখানে কী করে...

তারা যে কি বলে তা শোনা যায়না

স্বপ্নের মধ্যেই প্রবল বাতাস ওঠে....


জানি কেউ বিশ্বাস করবে না

তবু বলছি, একবার পাউন্ডকে দেখলাম স্বপ্নে...

বন্দিনিবাসের মাঠে বসেছিলেন এজরা পাউন্ড

আমি স্পষ্ট দেখলাম নীলাভ ডেইজিতে

তাঁর হাঁটু অব্দি ঢাকা  


অথচ স্বপ্নে নাকি কোনো রঙ দেখা যায়না 

একমাত্র সাদা কালো ছাড়া





কবিতায় চিরদিনের হওয়া নিয়ে কিছু কথা।। আবদুস সালাম

 কবিতায় চিরদিনের হওয়া নিয়ে কিছু কথা


সকলেই যেমনি কবিতা লেখেন না তেমনি সকলে কবিতা ও পড়েনও না। যারা পড়েন তাদের অনেকেই একটি কবিতার আবেগ, অভিজ্ঞতা ,অনুভব কিভাবে ধরা পড়েছে, পাঠকের মনে কিভাবে তখন পুনঃসৃষ্ট হচ্ছে সেসব বিচার বিশ্লেষণের প্রয়োজন বোধ করেন না ।তাছাড়া এই সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণের জন্য কবিতা পাঠের যে নিবিড় অনুশীলন ,রুচি ও রসবোধের পরিশীলন দরকার অনেক পাঠকের তেমনটি থাকে না।


     ভালো কবিতা লেখা যেমন সহজ নয় তেমনই সহজ নয় একটি কবিতাকে ভালোভাবে বোঝা এবং মূল্যায়ন করা। ভালো কবিতা লেখা হলে তার আবেদন যুগকে অতিক্রম করে।এলিয়ট বলেছেন "Genuine poetry can communicate before it is under stood"


     তবু ও কবিতার সামগ্রিক মূল্যায়নকে অস্বীকার করা যায় না। যদিও কবিতা ভাব দিয়ে লেখা হয়না, শব্দ দিয়ে লেখা হয়।

  একটা সার্থক কবিতায় কবির ভাবনা মিশে যায় অনন্ত কালে।

  " কবিতা একধরনের হৃদয় চর্চা।হৃদয়ের কাছেই কবিতার আবেদন একথা পুরোনো হলে ও আজ তা সত্য । পৃথিবী জুড়ে যদি মানুষের হৃদয় না থাকে অর্থাৎ সব হৃদয়ের মৃত্যু ঘটে তবে কবিতারই বা ভবিষ্যৎ থাকবে কেন? কবিতা কার কাছে বাঁচার আবেদন করবে?" -----তৈমুর খান


জীবনানন্দ বহু আগেই একটি কবিতা তে হৃদয়ের কথায় বলতে চেয়েছিলেন-----

   "যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

 এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় মহৎ সত্য বা রীতি,

 কিংবা শিল্প অথবা সাধনা শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয় "---জীবনানন্দ দাশ


    কবিতা লিখে অমরত্ব চেয়েছিলেন' মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত 

তিনি বলেছিলেন" রেখো মা দাসেরে মন

 এ মিনতি করি পদে-"-- 


আমরা কি কবিতা লিখে অমরত্ব লাভ করতে পারব ? কবিতা লিখে যশস্বী হতে পারব ?

    কবিগুরুকে শতবর্ষ পরেও স্মরণ করে চলেছি।  

 প্রতিদিনের কষ্টকর মুহূর্তগুলো ,গ্লানিগুলো, অসহায় হাহাকার গুলো গুঁজে দিচ্ছি কবিতার শরীরে । আমরা যেসব কবিতা লিখি সেসব কবিতা কি আদৌ কালের ধোপে টিকে থাকতে পারবে ? আমাদের বেঁচে থাকা, দিনযাপনের ক্ষণে বিচ্ছিন্ন মুহূর্ত গুলো ঝরা পাতার মতো ছুটে বেড়ায় । আমরা তাদের ধরে এনে কবিতার পঙক্তিতে বসানোর চেষ্টা করি। এতে আমাদের বোধের যতো উত্তরণ ঘটে তাতে কিন্তু ভবিষ্যৎ ভাবনা থাকে না। প্রতিক্ষণে আমাদের প্রেম ছিন্ন হয় ,বেকারত্বের জ্বালা আমাদের কে কুরে কুরে খায়। কাজ হারানোর দায় কাঁধে চেপে পড়ে ।রাজনৈতিক টানাপোড়েনে আমরা বিধ্বস্ত হই বারবার ।আমাদের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর হিসেব-নিকেশে আমরা ডুবে থাকি । 


     অপার্থিব্য চেতনা আমাদের আকৃষ্ট করে না । তবু সবাই কবিতা লিখে চলেছে, লিখে চলেছি। এই প্রজন্মের ভূগোলে উঠে আসছে নতুন নতুন কবিমুখ ।কবিতা তারা লিখে চলেছে তাদের অভিমান , তাদের বিদ্রোহ, তাদের জটিল জীবনের অন্বয় ।ক্লান্তিকর জীবনের ছায়ায় বেড়ে উঠছে তাদের কবিতা ।যন্ত্রণাবিদ্ধ হচ্ছে সময়। সময়ের মর্মে মর্মে গেঁথে দিচ্ছে আবেগের স্বর । 


     আমরা দিন দিন হয়ে চলেছি নকল বাজ। অন্যের যাপন চিত্র নকল করে চলেছি অবলীলায় ।গভীর রাতে যন্ত্রণার সমুদ্রে ডুব দিয়ে নিজেকে খুন করে চলেছি নিয়ত । এ সময় আমরা যে মানুষ সে কথা ভুলতেও বসেছি । এতে আমাদের কোনো বিকার নেই , অনুতাপ নেই ।গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলেছি । অধুনা সভ্যতায় ঘটে চলেছে মনুষ্য দূষণ,মনন দূষণ, পরিবেশ দূষণ। নাগরিক সভ্যতায় গড়ে উঠেছে শুঁড়িখানা ,বেশ্যাখানা । তৈরী হচ্ছে বেশ্যানগর, তৈরী হচ্ছে বেশ্যা সভ্যতা । ভালোবাসা দিন দিন পরিণত হচ্ছে রেশমকীটে । তৈরি হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। বাস্তবের দোহায় দিয়ে ক্লান্তিকর জীবনের ছায়ায় বেড়ে উঠছে কবিতার গাছ । কবিতা। হয়ে চলেছে দিন দিন যন্ত্রণালব্ধ মরমী শব্দের সমাহার।

    শিল্প সাহিত্য নিয়ে একটা প্রবাদ লক্ষ্য করি "সমাজে যাহা ঘটে চলেছে তাহায় সাহিত্য"--- অবশ্যই এটা সত্য কথন । কেননা সাহিত্য তে সমাজের দর্পণ। তবে প্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি বাস্তববাদী সচেতন শিল্পী, সাহিত্যিকবৃন্দ বলেছেন অন্যকথা। তারা সর্বদায় বলেছেন সাহিত্যের কাজ কেবল মাত্র সমাজের দর্পণ হওয়া নয় , তাদের দায় অনেক বেশি বৃহত্তর । একজন সমাজ সচেতন শিল্পীর কর্তব্য -সমাজে যা ঘটে তা শুধু প্রকাশ করা নয়, সমাজে যাকিছু ঘটা উচিত ছিল তার সম্ভাব্য রূপ কে রূপায়িত করা ।  


   এখন প্রশ্ন কবিতা কি আমাদের এই সকল শর্ত পূরণ করতে সক্ষম? কবিতা সকলের পাঠ্য তালিকায় জায়গা করে নিতে সক্ষম?কবিতা কি সকলে পড়ে ? কবিতা নিয়ে আমাদের যে এতো ভাবনা তাকে পাঠক কতটা সমাদর করছে--প্রশ্ন থেকেই যায়। তা নিয়ে আমাদের ভাবনার বিষয় না হলে ও এর ভাবনা থেকে আমরা সরে আসতে পারিনা। 


   তবুও কবিতা লেখা হচ্ছে প্রতিদিন। জন্ম হচ্ছে অজস্র কবিতা । প্রতিদিনের কবিতায় আমরা লিখে যাচ্ছি আমাদের অভিমান, আমাদের বিদ্রোহ, আমাদের জটিলতা, আমাদের প্রেম আমাদের সংসার যাপন । ক্লান্তিহীন ঝড়ের বিপন্ন ছায়ায় কবিতা জিরিয়ে নিচ্ছে প্রতিদিন । ক্লান্ত বিপন্ন জীবনের কথা কি আগামী সভ্যতার প্রজন্মের কাছে উত্তরণের পথ দেখাবে?


             জীবনযন্ত্রণায় হতাশার অন্ধকারে আচ্ছন্ন আমাদের জীবন। আমাদের প্রতিনিয়ত চলাফেরা, আমাদের প্রতিনিয়ত যাপন, আমাদের জীবনের অসহায় মুহূর্তগুলোকে গ্রাস করে চলেছে ।সেখানে একাকীত্ব , হাহাকার ,হতাশা ,করুণ অসহায়গুলো আমাদের জীবনকে নিরাপত্তাহীনতায় ভরিয়ে তুলেছে। তাই সমসাময়িক কালের পরিপ্রেক্ষিতে জটিল জীবনযাপন সম্পর্কে টানাপোড়েন ,বিশ্বাসহীনতা, রাজনৈতিক খুনোখুনি থেকে আমরা কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছি না । তবুও কবিতা লেখা হচ্ছে প্রতিদিন।


 কবি কবিতায় লিখে চলেছেন প্রেম অথবা প্রেমহীনতা, প্রকৃতির রূপ ,বৈচিত্র, মানব মনের নানা জটিলতা, সমাজজীবনের কীর্তি, বিপর্যয়, আবেগ অনুভূতি ও মননের সংশ্লিষ্ট আরো কত নানান বিষয় কবিতার শরীরে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। শব্দের, চিত্রকল্পের অভিনবত্ব, আঙ্গিক আর কৌশলের ভিতর যেতে হয় কবিদের। ব্যক্তি বিশেষের তাৎক্ষণিক আবেগ ও অনুভূত হয় কবিতার শরীরে।


     নানা আঙ্গিকে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হয় কবি কে ।কবিতার তাৎপর্য নিছক বুদ্ধিচর্চায় আবদ্ধ থাকলে চলে না। ব্যক্তিগত আবেগ অভিজ্ঞতা কবিতার শরীরে সেঁটে দিতে হয় । পার্লারে গিয়ে যেমন কুৎসিৎ বউ কে সুন্দরী সাজিয়ে আসরে বসানো হয় তেমনি কবিতা কেও সেই ভাবে অলংকার দিয়ে কবিতা যোগ্য করার প্রয়াস চালানো হয় ।আবেগ জা্রিত মনন, মননের উদবর্তন ও উদ্ভাসনই কবিতার উত্তরণ ঘটায় । নৈর্ব্যক্তিকতা কবিতার মূল্যায়ন স্থায়িত্ব করে ।কবির ব্যক্তিগত ভাবনা ,বিশুদ্ধ চিন্তা ইত্যাদিকে কৃত্রিম বৈধতা দেবার চেষ্টা করেন ।আবেগ-অনুভূতি মনন , প্রভৃতি শাব্দিক উদ্ভাসন একজন পাঠক সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন। শব্দের নির্মাণ , শব্দের চেতন গত বৈশিষ্ট্য, চেতনার নীবিড় সমবায়ে রচিত হয় কবিতা।


 শব্দ দিয়ে যখন কবিতা তৈরি হয় তখন আমরা দেখি একজন প্রতিভাবান কবি পুরনো শব্দ কে ঘষেমেজে নতুন শব্দ তৈরি করেন , চেষ্টা করেন নতুন রূপ দিতে ।সুর ও চেতনার সঙ্গে সার্থক সমন্বয়ে স্মৃতিময় শব্দ বিন্যাসে উদ্ভাসিত হয় কবিতার অন্তঃসত্ত্বা ।শব্দ নির্বাচনের সচেতনতা কবিকে অমরত্ব দান করে । কবিতা সম্পর্কে কেউ বলেছেন প্রথম শ্রেণির কবির প্রাথমিক কাজ মৃত শব্দকে সঞ্জীবিত করা, আর পুরনো অচল শব্দ বর্জন করে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করা। ভাষা ও ছন্দকে প্রাণবন্ত করা ।সংস্কৃতির সজীবতার লক্ষণ হলো প্রাণবন্ত শব্দ ভাষা প্রয়োগ করা ।শুধু অক্ষরের বিন্যাস চেতনার ধারক বাহক ও বটে ।কবিতার শরীরে নতুন শব্দ যেমন চমক আনে তেমনি পাঠক সমাজকেও কবিতার শরীরে ডুবে যেতে আমন্ত্রণ জানাই।


ভাষা বৈশিষ্ট্য কবিকে অমরত্ব দান করে। জীবনানন্দের কবিতায় দেখি সেই সব অনবদ্য চিত্র কথা , শব্দ বৈচিত্র।


"চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা--"-

"পাখির নীড়ের মতো চোখ"

"শকুন শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়---"

জীবনানন্দ দাশ


"তাই দুটো পায়ের মধ্যেকার দূরত্ব দেখে বোঝা যায়

সে আজ কতো ভোরে উঠেছে--"-

ঋত্বিক ত্রিপাঠী


" কুমারী নক্ষত্রের পবিত্রতা----

ধূসর শূন্যতার পথে বানিজ্যে চলেছে বণিকেরা---

ভোরের ক্লান্তির কাছে মনে পড়ে শূন্যতা---

প্রকৃতির ছদ্মবেশ খুলে যাবে লৌকিক কথনে---

নির্বিকার পৃথিবী প্রতিদিন থলে হাতে বাজারে গিয়েছে---" নাসিম এ আলম

নৌকার চেয়ে ও ছোট হয়ে এসেছে নদী---

আমি তার কিনারায় বসে বাজনা বাজায় আর চাপা দিই মানুষের কান্না---

সঙ্গীতের পোড়া গন্ধের মত সূর্য---

ঢেউয়ের মধ্যে সমুদ্র মূর্ছা গেল---

পুবে পারদের নীচে ডুবে যাচ্ছে আকাশ---

ধীরে বয়ে যাচ্ছে সময়

মেঘের মধ্যে দোকানের অনুভূতি

নিরবতায় বেঁচে রয়েছে মানুষের মনে গোঙানি তারা এখন ও হেঁটে বেড়াচ্ছে স্যাঁতস্যেঁতে বুদ্ধিতে---

  গোলাম রসুল


গাছেরা রাতের ছাদে সর্বনাশের গান করে--- 

মরীচিকা প্রেম সনির্বন্ধ ক্রিয়াশীল হলে রাত নেমে আসে শরীরের হাটে---

 ভেসে যায় সভ্যতা

 সুন্দরীরা শুকায় চুল ----

মানবিক মুখ সেলাই করে চেনা চেনা দুঃখ---

 উঠোন জুড়ে জাতীয় সড়কের ক্ষতচিহ্ন----

 ঘরে ঘরে দুঃখের উনুন----

 বিবর্তনের গা ঘেঁষে পুড়ে যায় শ্বাসকষ্ট---

অসফল ধূসর স্বপ্নেরা চৈত্রের ঝড়ে ঠুংরি গায়---

  পূর্ব পুরুষেরা ইতিহাসের মলিন পৃষ্ঠায় এঁকে রেখেছে রক্তের জলছবি---

 মরা নদীর পাশ দিয়ে হেটে যায় অবিশ্বাস---

আবদুস সালাম


টুকরো টুকরো ছায়ায় আমাদের নষ্ট বিশ্রাম 

অপেক্ষায় আছে----

 আমাদের ছেঁড়া বর্ণপরিচয় প্রতিটি সকাল চেনে----

 তোমার কুয়ো থেকে তুলে নিচ্ছি দুঃখ----

 মুরগি জন্মের পর সভ্যতায় কোন সকালে আসবে?----

 শহীদের রক্তের আলপনায় তৈরি হয় ইতিহাসের নকশা---

 ক্রমশ বার্ধক্য আসে

দোকান গুলো সব বন্ধ হয়ে যায় একে একে---

 নিজেদের ম্লান ছায়ার ধারে অন্ধকার এঁকে রাখি--- 

আত্মঘাতী তীব্র নীরবতা ----

গলায় কলসি অথবা বালতির হুঁকে

 যৌবনের নীল মেঘ ভেসে ভেসে আসে----

 একটি বিপন্ন ঘোড়া

 পিঠে সংসার চেপে আছ

 দীর্ঘশ্বাস ফেলছে সদস্যরা----

তৈমুর খান


এমন সব বাক্য বন্ধ কবি কে চিনতে সাহায্য করে। শিল্প সাহিত্যের স্রষ্টাগণ নতুন নতুন ভান্ডার উজাড় করে দিচ্ছেন পাঠকের দরবারে । চিরদিন এই শব্দের খেলায় মেতে চলেছেন কবি কূল।যে সকল কবি সাহিত্যিকবৃন্দ নিজেদের নতুন করে তুলতে সমর্থ হয়েছেন, যুগের পারে অন্য যুগে জমিয়েছেন পাড়ি। তাদের কে আমরা মনে রেখেছি ‌। যুগের কষ্টিপাথরে তারা উত্তীর্ণ। মানবিক প্রাণ দেওয়া-নেওয়া , জীবনে জীবনের যোগ করে বাঁচিয়ে রাখে স্বপ্নকে ।স্বপ্নের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বর্তমান সময়ে এই একান্ত অনুভব এর মুহূর্ত উপহার দেন । আবেগ বা হৃদয়ের স্পন্দন আমাদের কমে আসছে । মানবিক পৃথিবীর মরে মরে যাচ্ছে ক্রমশ ।জীবন গঠনের প্রক্রিয়ায় যে অনুভব , সামাজিক দূরত্বে অবস্থান করে তার সনির্বন্ধ নির্যাস কবিতায় তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করি ।ছোট ছোট কাব্যরসে প্লাবিত হয় কাব্যের মাঠ । আগামী দিনগুলোর সম্ভাব্য মরমী কথা তুলে ধরেন কবিতায় । আগামী প্রজন্ম খুঁজে পায় তাদের আত্মার কথা । মনে হয় হয় এ কবিতা এখন ই লেখা হয়েছে । এর আবেদন চিরকালের । আর তখনই কবিতা কাল জয়ী হয়ে অনন্ত কাল বিরাজ করে । যতদিন তার প্রবৃত্তি থাকে , আবেদন থাকে ,অন্যকে কাছে ডাকার আকুতি থাকে ততদিন সেই কবিতায় দৌড় থাকে । আর এটাই হলো কালজয়ী , চিরন্তনী । তখন কবিতা লালিত হয় ,ডানা মেলে ওড়ে । মানুষ স্বপ্নের ভাষা খুঁজে পাই । 


      আবেগের কাছে আমরা সকলেই দায়বদ্ধ। আত্ম সর্বস্ব জীবনে আমরা বন্দি হয়ে নিজের সুখ উপভোগ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারিনা ।তখন এই সকল মরমী কবিতার আবেদন ভবিষ্যতেও সঞ্চালিত হতে থাকে । এখানেই কবিতার অমরত্ব। আত্মগত জীবনের ভিতরে যখন কবিরা নিজেদের গুটিয়ে নেন ,পৃথিবীর মানুষ তখন মানুষ- কসাই সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ।আমরা চিনতে পারিনা কে খুনি কে সাধু ।মুখোশের আড়ালে আত্মিক জগতে তারা বন্দী হয়ে যায়। যন্ত্রনির্ভর সভ্যতায় মানুষ ক্রমশ হয়ে উঠেছে যন্ত্রনির্ভর । মানব জীবনে যত বিলাসিতা , যত অশ্লীল আনন্দে নিজেকে মাতিয়ে তুলছে ততই মানুষ আহ্বান করছে মৃত্যু কে । কবিতা শুধু বেঁচে থাকে হৃদয়ে ।আর হৃদয় যদি না থাকে তবে কোথায় থাকবে ? কবিতার সমালোচনা ধোপে অবশ্যই মহান কবিদের কৃতিত্ব কে ম্লান করা যায়নি ।তাদের কবিতায় বিশ্বের মানুষ বারবার সামাজিক ও নৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হয়ে সৃষ্টিশীল হয়ে পথের নির্দেশ দিয়েছে । এখানেই কবিতার সার্থকতা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ খুঁজে পাই নজরুল ইসলামের কবিতায়।


  মানব সভ্যতার বিভিন্ন যুগে সমাজ সচেতন ও সংবেদনশীল শিল্পী-সাহিত্যিকরা শিখিয়েছেন মহান কর্মকাণ্ড ও সমাজব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। মানুষের মনের অন্ধকারকে দূর করে দিতে প্রেরণা যোগায়। তাকে সামাজিক কর্তব্য পরায়ন করে তুলতে সাহায্য করে । এগুলো প্রকাশ করা , জন সমক্ষে আনা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া শিল্প-সাহিত্যের স্বাধীন কাজ ও কর্তব্য ।অবশ্য অতি বাস্তববাদী surrealist বাmetaphysical শিল্পী মহলে এ কথা মানে না ।তবে তারা এমন কিছু প্রকাশ বা সৃষ্টি করতে চান যা সামাজিক প্রগতিকে ব্যাহত করে, এটাই নাকি এদের কাছে শিল্পের স্বাধীনতা ।এদের কাছে মানুষের যথার্থ পরিচয় মানে তার পেটুকতা ,লালসা ,যৌনাচার ইত্যাদি শারীরবৃত্তীয় পরিচয় । রবীন্দ্রনাথ এদের সম্পর্কে বলেছেন "এরা দুর্বল দেশে মাঝে মাঝে রাজ সিংহাসন হরণ করে নেয়, কিন্তু মানব ইতিহাসে কোথাও কোনো স্থায়ী গৌরব লাভ করতে পারেনি"।কদর্য বাস্তব বর্জিত, শারীরবৃত্তীয় চটুল কবিরা হয়তো সাময়িক ভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে কিন্তু কালের গতি তাকে ভাসিয়ে দিবে অথৈ সাগরে।


   মাইকেল মধুসূদনওরবীন্দ্র পরবর্তী বহু কবি এসেছেন গীতিকবিতার প্রবাহমান ধারা কে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে, রূপবতী-লাবণ্যময়ী করে তুলতে । আমরা কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ,বিষ্ঞু দে ,অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ,জয় গোস্বামী, ইদানীং একদম হাল আমলের কয়েক জন কবি অলোক রঞ্জন দাস গুপ্ত, কাওসার জামাল, মন্দাক্রান্তা সেন, তৈমুর খান, গোলাম রশুল এর কবিতা পড়ছি । কবিতার মানচিত্র অনেক বড়ো হচ্ছে এতে কোন সন্দেহই নেই। তবে কালের প্রবাহে কতো জনের কবিতা কালজয়ী হবে তার সময় বলবে । সমাজের প্রয়োজন বাস্তবসম্মত , সচেতন যুক্তিগ্রাহ্য শিল্প সাহিত্য।যার দ্বারা আগামী মানুষ খুঁজে পাবে আশার আলো, খুঁজে পাবে সুন্দর সমাজ গড়ার প্রেরণা। গড়ে উঠবে সুস্থ সংস্কৃতি। আমরা কবিতা কে কালের নৌকায় চাপিয়ে দিলাম।

মধুসূদন দরিপা

 আফগানিস্তানের মা

সব গাছ কাটা পড়েছে

সব বাড়ি ভেঙে পড়েছে

সব নৌকো ডুবে গেছে

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও

মেঘ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে

পাহাড় ভেঙে ধস নেমেছে

অরণ‍্য জুড়ে আগুন লেগেছে

মরুদেশ জুড়ে ঝড় উঠেছে

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও



জল নেই

মাটি নেই

গাছ নেই

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও


চারদিকে শুধু বুটের শব্দ

চারদিকে শুধু বুলেটের গন্ধ

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও

রাতের অন্ধকার নিভে গেছে

দিনরাত চারদিকে শুধু তীব্র আলোর ঝলকানি

এতোটুকু আড়াল নেই কোথাও

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও


ওরা জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে

সব জানোয়ার শহরে ঢুকে পড়েছে

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও

তীব্র ঝঞ্ঝপ্রবাহ চলছে

বিদ‍্যুত সংযোগ বিচ্ছিন্ন

গাঢ় অন্ধকার দেশ জুড়ে

একটা প্রদীপ জ্বালতে হবে

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও


সাঁজোয়া গাড়িতে ছেয়ে গেছে গ্রাম শহর

আতঙ্কে মানুষের অঙ্গ প্রত‍্যঙ্গ সব অকেজো হয়ে গেছে

বাড়িতে আটা ময়দা মজুত আছে, চাকি বেলনাও

কিছু রুটি বেলে দিতে হবে

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও

এবারও আমাদের রথে চাপা হবে না

আকাশ দেখা হবে না

উল্টে আকাশ থেকে পড়ে মরতে হবে

রথের চাকায় পিষে মরতে হবে

আমাদের কবর দেবার কেউ নেই

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও


১০

আমাদের দেশে অগুনতি পাহাড় আছে

পাহাড়ের গুহা আছে

গুহাতে ম‍্যানইটার অ্যনিমেল আছে

পাহাড়ের গ্রামগুলি দৈত‍্যদের দখলে

অধিবাসীরা পাহাড় ছেড়ে নেমে আসছে সমতলে

এদেশে কোন তল সম নেই আর

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও

১১

বোমা বারুদের গন্ধে তাপমাত্রা বেড়ে গেছে

হিমবাহ গলে প্লাবন নেমেছে দেশে

 প্লাবনে বাঁচতে শেখেনি স্থলবাসী

যন্ত্রদানবেরা শুধু বেঁচে আছে

এদেশে যন্ত্র মানে বন্দুক সাঁজোয়া গাড়ি

নোয়ার নৌকা খুঁজে দেবে

মাগো দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও


১২

মুখ ঢেকে রাখো মেয়ে

নয় তো কবরে যাও

বেছে নাও জীবন

আর আলো নয়, কালো

কোথায় বুদ্ধ, হে তথাগত

মাগো, দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও

১৩


বোমা আর গ্রেনেডের দাপটে

কুরআনের সূরা তওবার আয়াত

নিষিদ্ধ হয়েছে এই মুল্লুকে বহু বহু দিন

যুদ্ধ এ দেশে এসেনশিয়াল আজ

মৃত্যু এ দেশে এসেনশিয়াল আজ

হা হাসান হা হুসেন

মাগো, দোহাই একটু দাঁড়িয়ে যাও





ঋষিকা মন্ডল

 গুচ্ছ কবিতা


আহ্বান


একটা গোটা আঁশটে গন্ধ বাড়িটাকে মুড়ে ফেলার আগেই যে আসবাবে এখনও রঙের আস্তরণ লেগে, সেগুলো যত্ন করে রাখতে হবে...

তোমার দেওয়া নূপুরের আওয়াজের শিকড় বাকড় সাপের ফণার মতন গোটা বাড়ি গিলে নেওয়ার আগে, তোমায় আসতে হবে...

অথর্ব শক্তিহীন ধুলোয় মিশে যাওয়ার ঠিক আগে,

তোমায় আসতে হবে...

আনাচে কানাচে তোমার হাসি মিলিয়ে যাওয়ার আগে...

আসতে হবে...



এক আকাশের নিচে


চেনা ছায়া চলে যায়...

বুদবুদের মত মিলিয়ে যায় মেঘের আড়ালে,

 যে মেঘের নিচে আমরা ছিলাম।...


পাহাড় কে সাক্ষী রেখে হেঁটে গিয়েছিলাম অনেক পথ...


প্রতিটা বাঁক বুঝি আমাদের হিসেব রেখেছিল...

ধ্বনি প্রতিধ্বনি তে বর্ষা নেমেছিল অকালেই...

প্রতিটা ফোঁটায় জেগেছিল শিহরণ...

 

আজও এক আকাশের নিচে...

 নেমেছে অঝোর শ্রাবণ

শুধু ধুলোমোড়া স্মৃতি দের শরীর ভিজছে...


কথার স্রোত


কথার স্রোত বুঝি মানুষ কে তলিয়ে দিতে পারে?

ঠিক ঘূর্ণির মতন....

অবলম্বন ভেঙে আজ টুকরো গুলো এধার ওধার হয়ে রয়েছে...

কাঁচ ফুটে রক্তের ধারায় তোমায় যেন গাঢ় ভাবে দেখতে পাই...

সমুদ্রের জলরাশির মতন ধরা ছোঁয়ার বাইরে...

যেমন অতল, অনন্ত....দিকশুন্যপুরের বাসিন্দা হয়ে হাতছানি দিচ্ছ....

ধরতে পারবো তোমায়?

মিলিয়ে যাবে না তো........






তীর্থঙ্কর সুমিত

 ঘড়ি


বন্ধ ঘড়িটা এখনো চলছে সময়ের সাথে সাথে

কিছু প্রয়োজনীয় কিছু অপ্রয়োজনীয় জৈবিক ক্রিয়া

মাঠ জুড়ে ভালোবাসার সমীকরণ

হাত বদলালে মুখোশের রঙ পাল্টে যায়

তোমার অপেক্ষা চিলেকোঠা ছড়িয়ে আজ ছাদের কিনারে

আমিও সকাল দেখি


আর ঘড়িটাও নতুন হয়ে ওঠে। 





খগেশ্বর দাস

 মমির তর্জনী

                                    


মমির তর্জনী জেগে আছে আশ্চর্য ঘুমের মধ্যে

                                       সবকটি জনপদ স্তব্ধ

বিশল্যকরণী নেই ভেষজ বাগানে । 


কুরুক্ষেত্রে এ কেমন পুতুল সৈন্যেরা

প্রতিরোধের হুঙ্কার নেই

কার অঙ্গুলি হেলনে ইতস্ততঃ পড়ে আছে 

                        পথের ধারে রথের ভাঙা চাকা । 


ইতিহাসে কোন কালে থামেনি পতাকা উত্তোলন

একছত্র জয় কোনদিন দীর্ঘস্থায়ী নয়

স্তম্ভিত মেঘের বৃষ্টি ধুয়ে দেবে

                                     সময়ের গতানুগতিক । 


যদি কোন পদাতিক জয়ের দুয়ারে

                    জোরে জোরে আস্ফালন তোলে

তবে নদী বাঁক নেবে নতুন স্রোতের পথে

                  পাশে পরিত্যক্ত হ্রদ অশ্বক্ষুরাকৃতি।    




হামিদুল ইসলাম

 ফাগুন কথা                              

                              

ক্রমাগত পাল্টে যাচ্ছে জীবন ছন্দ 

এতোদিনের ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলছে তাবৎ অরণ‍্যভূমি 

স্বাস্থ‍্যহীন বিকেল ফিরে আসে 

রোদের বদ্বীপ 


আমরা পেরিয়ে যাচ্ছি শীত 

হাওয়াদের ব‍্যালকনি বাড়ি 

মাঝে মাঝে জড়ানো চাদর খুলে রাখি গায়ে 

দিবাস্বপ্ন নৈর্ঋত 


এখনো শরীর শরীর গন্ধ 

শরীরী ছন্দে বরাবর ফাগুন কথা 

ঘরে ঘরে শিমুল পলাশ ভাটফুলের নরম সুবাস 

হৃদয়ে উৎসব 




স্নেহাশিস মুখোপাধ‍্যায়

যেন প্রেম যেন উচ্চাশা 

 

(১)

 

যেন প্রেম। যেন কয়েক ঘণ্টার অবলোকন।  

প্রথমে কপাল - কপালের মাঝখানে জাগতিক জলছাপ -  

তারপর লোকালয় ছেড়ে নিরুদ্দেশ!

সোনার হাঁসের জন্য, সারাক্ষণ,

আমি তোমার ছবিতে হবো পাগলপণ!

সোনার হাঁস, তুমি শুধু অবলোকন।  

 

গায়ে গায়ে বাড়িগুলো আমি আর তুমি।

পায়ে পায়ে, মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি -

চোখের অমৃতবর্ষণ!

আমি তোমার জন্য হবো পাগলপণ!

 

যেখানে কেউ নেই, সেখানেই প্রেমকে মানায়।

শুধু মূর্তির মতো কিছু গাছের ছায়া চাই।

নদীতে পাথর থাকবে নদীর আবেশে...

বার বার একই কথা লিখে আমি প্রেম বুনে যাবো।

প্রেমের কথা বার বার বলতে হয়।

যেন পৃথিবীর সবচেয়ে পুণ্য কোনো ধর্মের গান!

এই অবলোকনে শুধু তীর্থের মতো শরীর মিশে যাবে।

একশো শ্লোক আমি যদি দেবভাষায় লিখতে পারতাম...

এই আক্ষেপ থেকে যাবে।

 

(২)

 

একটা ট্রেনের মতো ছিপছিপে দিন নেই।

‘পুনশ্চ’-এর কবিতাযাত্রা নয়,

আমি চাই থেমে থাকা পরখ করতে।

অথচ তেমন সম্বল নেই।

রথের রশিতে টান দিতে হবেই।

নাহলে, চলার মানে থেমে গিয়ে রাতের ঘুম কেড়ে নেবে।

এই শীতের দিনে আমি হিমাচলে গিয়ে তোমাকে খুঁজবো,

এই-ই যদি একটা প্রতিজ্ঞা হয়ে উঠতো!

যুক্তি-তর্ক ছাড়া কেন প্রেম আসে না উন্নত?

উন্নত শৃঙ্গের মতো তার মন হবে আলোর মুখ।

আমার লেখার ভাষা মধ্যযুগীয় হয় হোক,

সমস্ত পাথরের গায়ে গায়ে অমর লিপির মতো বাণী হোক,

তোমাকে হঠাৎ দ্যাখার মতো এক একটা কল্পনা

আমি যেন প্যাঙং হ্রদের ধারে নীল জলে খুঁজে নিতে পারি।

এতোখানি অবলোকনের গান কে গাইবে বলো?

একটা ট্রেনের মতো - ছিপছিপে ট্রেন...

আমি তার আত্মা হয়ে যেন জলে নেমে যেতে পারি।

 

(৩)

আলাপ না হলে গাঢ় প্রলাপ হয় না।

যারা বোঝে, তাদের প্রেম হয় না।

একটা গুহার কথা ভাবো তুমি রানী!

তোমার মন খুব শুকনো হয়ে আছে।

বুকের ভেতরে কোনো উন্মাদ আগুন জেগে আছে।

সে আগুন ধ্বংসের। প্রেমে কিছু ধ্বংস হয় না।

তুমি গুহার ভেতরে চলে যাও। 

বেশ শীত যেসব গুহায়, বেশ অন্ধকার যেসব তন্দ্রায়,

বেশ বরফ যার আগে-পড়ে জ’মে ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ে,

তুমি সেখানে আমার জন্য আগুন জ্বালো।

কি অবিশ্রাম লেগে থাকা রাত - বুকের ভেতরে জড়োসরো হয়ে আছে।

আমি তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে মানেবই মুখস্থ করবো।

তুমি অর্ধনারীশ্বর হয়ে থেকো না।

তিস্তার বর্ষা হয়ে, গ্রহ ও নক্ষত্রে উপচে ওঠো।

প্রাণ-বসুন্ধরার অনেক ঘুমের শিস শুকনো ধারণার মতো একপেশে।

তোমার গানের জড়তার পাঁপড়ি খুলে দেবে কে?

সেই ধাবমান কাল গড়িয়ে গড়িয়ে কোনোদিন ওপরে উঠবে?

ধাবমান নয়, ধবধবে লতানো ত্রিতাল তুমি।

তোমাকে কি শহরে মানায়?

তুমি যেন মধ্যবর্তী - কথা আর কথার ছলনায়।

 

(৪)

 

এভাবে কে লেখে বলো?

 

           ফুরিয়ে যাওয়ারা?  

 

তাই ভাবো বুঝি?
           দ্যাখোনি, চোখা-শব্দগুলো জলছলছলকলকল...

ঢলঢলে মুখ তোমার -

           জ্বলজ্বলে ঘড়ি।

আরো বেশি গভীর হতে চাও?

           পরো তবে মাঘের আশাবরী-শাড়ি। 

(৫)

প্রথমেই তেহাই গেয়ে সব ভুল করি।

আমি তো তেমন করে গান জানি না!

গানের কৌশল কি করে জানবো বলো?

কিন্তু তেহাই কতো আন্তরিক!

           তিনবার নয়, অনেক তেহাই গেয়ে ফেলি।

ঘুমের ভেতরে আমি বৈষ্ঞব -

           বার বার করে তোমার নামের তেহাইগুলো পড়ি।

আমি কি তোমার জন্য তির্যক হবো?

           তির্যক হলে তোমার আরাম হয় বুঝি?
তুমি খররোদ কোনোদিন ভালোবাসোনি?

           আমি তো নিজেই তির্যক রশ্মির মতো জেগে থাকি।

 

(৬)

 

উপচে ওঠা দুধের মুখে উপচে ওঠে ঘুম।

নরম নাভির বন্দরে জিভ কতোটা ভিজলো,

আমার ইচ্ছেশক্তি তা কি জানে?

তুমি ভাবছো বন্দর তো পারের মতোই ক্ষীণ!

তাকে কেন কেন্দ্রবিন্দু করতে চাইছে দিন?

এমন কি সেই গভীর গর্তে কেন্দ্র থাকে নাকি?

কে মাপবে সেই জরীপকার কি শরীর মেপে দ্যাখে?

দেখলে; পেতো...বন্দরটাই সমুদ্র-কেন্দ্র।

নাহলে কি আসা-যাওয়ার রাস্তা হতো নাকি?

উপচে ওঠা দুধের মুখে উপচে ওঠে ঘুম।

নরম নাভির বন্দরে জিভ কতোটা শুকনো,

তোমার ইচ্ছেশক্তি তা কি জানে?

আর সমুদ্র কি বাধাবন্ধহীন?

হীন লাগে আমার, যখন স্বপ্নে তোমায়

দেখেছি অন্নদা! কিন্তু তুমি অন্নদা নও,  

রেলের একটা দু-তিন ঘণ্টা যাত্রা।

তোমার বুক পাথর হলে পাথরে ফুটতো নতুন একটা পাতা।

তুমি যেন হঠাৎ করে শহর ছেড়ে অজ পাড়াগাঁয় গেছো।

তোমার মুখে এতোখানি মর্ম খুঁজি নাকি?

তোমার ঘরের ভেতর একটা কাচের আলমারি -

তার ভেতরে বই আর কাচ, মাটির বাসনকোসন রাখা।

তুমি তার পাশে দাঁড়িয়ে আছো লজ্জাবতী লতা।

আমি প্রথম দিনের মতো করে তোমাকে খুঁজছি।

দ্যাখো, যারা কবিতা লেখে, তারা কেমন সংসারী!

আমি অন্য মুখে তোমায় ভুলে আবার খুঁজছি।




অনঞ্জন

 বর্ষা


বর্ষা, তোমার দুখ-লুকনো ফন্দি 

আমার ভিজে খাতায় লেখা,

বর্ষা, তোমার আগুন-জলে সন্ধি

আমার সব হারিয়ে শেখা।

বর্ষা, তোমার গাঢ়গন্ধী রঙে

সাজে স্বপ্ন দেখা প্রবাল,

বর্ষা, ওই ঝড়ের মতো ডাকে

জাগে ঘুমভাঙানি সকাল।

বর্ষা, তোমার লীলাময়ী ছন্দে

নারীর চিরকালের ঈর্ষা,

বর্ষা, ওই নীলমাধবের দর্পে

তুমি পরকীয়ার ভরসা।

বর্ষা, তোমার সকালবেলার ওমে

আমায় ভুল নামতা পড়াও,

বর্ষা, তুমি ডানায় আলো মেখে

আমায় ঘর পোড়াতে শেখাও।



তুষার ভট্টাচাৰ্য

 ক্ষুধার চারণভূমিতে 


ক্ষুধার চারণভূমিতে আমি ঝকঝকে চাঁদের থালায় করে 

জুঁই ফুলের মতন সাদা ধবধবে

গরম ভাতের স্বপ্ন দু'হাতের মুঠোয়

উড়িয়ে এনে

 ছড়িয়ে দিই হাড়হাভাতে বুভূক্ষু মানুষের 

আহত  স্লান চোখে l










গুচ্ছ কবিতা।।তৈমুর খান ।।

সমস্ত যুদ্ধের পর   অনেক মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকা  হেসে ওঠে মাঝরাতে  কোনও পিয়ানোর সুরে  খোলাচুল উড়ে আসে তার  বুকের ভেতর থেকে জ্যোৎস্নার ফণা ...