Showing posts with label তৈমুর খান. Show all posts
Showing posts with label তৈমুর খান. Show all posts

October 30, 2022

তৈমুর খান

১.

কাঙাল 

একটু স্নেহ হবে? 

এতকাল শুধু কুয়াশায় হেঁটে হেঁটে 

কোথাও বিশ্বাস খুঁজে পাইনি 

মানুষেরা অরণ্যে গেছে, সভ্যতা এখন অরণ্যনগর 


রাস্তার বিজ্ঞাপনে কত পান্থশালার নাম 

কত সুশাসকের স্ট্যাচু এখনও বক্তৃতা দিচ্ছে 

চারপাশে এখনও কত হাততালি 


আমি অন্ধকার মেখে গড়াচ্ছি কুসুমের দিকে 

কুসুমের নরমগালের রোদে কত স্নেহ ঝরে 

পৃথিবী মাতাল হয়, সভ্যতা স্বপ্ন বিলি করে 


দু’দণ্ড বসতাম পাশে 

কয়েক কদম হেঁটে গিয়ে 

আমার মৃত মায়ের জায়নামাজে ঘুমোতাম 

কখনও কোনও পাখি ডেকে দিত ভোর হলে 

জল নিয়ে ফিরত কোনও নারী নীরব স্নেহের হ্রদে 


আজ যদি বিশ্বাস এসে কাছে দাঁড়ায় 

আজ যদি প্রসারিত হাতে বিশ্বাস বলে :

দ্যাখো, কোনও অস্ত্র নেই….. 

স্নেহমাখা কুসুম তোমার অপেক্ষায় আছে! 


২.

তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে অস্তিত্বের উপর 


গৃহস্থ মাছেরা এসে দরজা ধাক্কায় 

আমার আদৌ কি কোনও দরজা আছে? 

এই সলিলে, সময়ের বিমর্ষ সলিলে ডুবে আছি 

তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে অস্তিত্বের উপর 


দাঁত, মুখ এবং কামড় একসঙ্গে এগিয়ে আসে 

আত্মরক্ষার কিছু নেই 

অতি সামান্য ভঙ্গুর কল্পনার বাড়ি 

বাক্-বিতণ্ডায় দরজা নির্মাণ —


মাছেরা ঘাই মারে 

বৃহৎ পুচ্ছ তাড়নায় কেঁপে ওঠে আশ্রয় 

কার তবে বন্দনা করি? 

এই জলে কোথায় আছ জলেশ্বর ? 

৩.

আমার কোথাও বাড়ি নেই 


ছেলে কোলে বসে আছে মেঘ 

বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আমি ফিরি 

সমস্ত আকাশ জুড়ে মেঘের কলোনি 

এগলি ওগলি পথে কত না কাহিনি 

শব্দের নাকছাবি পরে বসে আছে 

কল্পনার রানি 


আমার কোথাও বাড়ি নেই, দৃশ্যত অবলম্বন শুধু 

যে ডাকে তার কাছে যাই 

নক্ষত্রের গান শুনি 

জ্যোৎস্নায় যদি কারও ছোঁয়া পাই 

হিল্লোল নিয়ে এসে তবে 

ধারণায় নির্মাণ করি নতুন আশ্রয় 


কোনও কোনও বৃষ্টির রাতে 

দেখি ফিরে আসে মনের জানালায় 

অতীত স্মৃতির ধ্বনি 

আমি তার কাছে আমার সমস্ত চুমু রাখি 

আমি তাকে আবার নতুন জাগরণ পাঠাই








June 26, 2022

তৈমুর খান

 দুটি কবিতা 


১.
নিজেকে দেখেছি এবার 



অসুখ থেকে উঠে দাঁড়াচ্ছি দ্রুত মোটরগুলি চলে যাচ্ছে পতাকা নেই আমার
হে মানুষ, পতাকা নেই !

ঘৃণার জলে ভিজতে ভিজতে একটাও চালা নেই
সাইকেল নির্ভর জীবন
খণ্ডেৎ ত বিহীন বলে
উৎসব এল না আর



দূরের নকশা দেখে দেখে
কত পদ্ম ফুটল
চৈতন্য জাগল কলরবে
হাওয়ায় উড়ল সিংহাসন



একটা ভ্রমরের পেছনে পেছনে মধু সংগ্রহের উড়ান শুধু আর কিছু নয় 



সংশয়


সংশয় একজন বালক বলে
ওকেও মাঝে মাঝে ভিরু মনে হয় 


ব্রিজের উপর দিয়ে আমাদের গাড়িটি ছুটছে

ব্রিজও ছুটছে নাতো ?


আমরা ঝুলে আছি অনন্ত গভীরে

এখানে ভাঙা আকাশের টুকরো আর নিসর্গের নাভি স্বয়ংক্রিয় মায়াবীনিশীথ পড়ে আছে 



যেতে যেতে ভাবনারা নড়ে উঠছে 

ক্রমশ যেতে যেতে কেঁপে উঠছে আলো 

সংশয় কিছুই বোঝে না ——


 ঝুলন্ত মহুল বনেও নিশ্চুপ কোকিল 

টুপটাপ ঝরছে তার শৈল্পিক হৃদয়...




February 27, 2022

তৈমুর খান

কবিতাগুচ্ছ


 ১

সাক্ষাৎকার


 ভালো করে দেখা হলো না কিছুই

 শুধু ঝরনার কাছে দু'দণ্ড বসেছি

 অবগাহন করিনি কার জলে


 এলোমেলো বাতাস, ঝরা পাতা আর পাখির গানে

 অর্ধেক বয়স পেরিয়ে গেল


 বালিশের নিচে কার চিঠি রেখেছিলাম?

 আজ আর কিছুই মনে নেই

 ঝাপসা হয়ে গেছে চোখের দৃষ্টি

 নিজেকেই আর নিজেই চিনতে পারি না


 একটা মৃত বাল্যকাল আর উত্তর না দেওয়া চিঠির অভিশাপ

 সমস্ত গোধূলি জুড়ে বিস্ময় চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে

 আমি সাক্ষাৎকার দিতে এসে শুধু নীরবতাই অবলম্বন করেছি!


 ২

ছাতা


 আমার মাথার ওপর কোনো ছাতা ছিল না

 একে একে সমস্ত বর্ষাকাল গেল

 একে একে সমস্ত গ্রীষ্মকাল গেল

 বৃষ্টি আর বজ্রের সামনে দাঁড়ালাম

 সূর্য আর তাপের সামনে দাঁড়ালাম

 

 আমাকে সবাই ভয় দেখাল

 আমাকে সবাই মৃত্যু দেখাল

 আমাকে সবাই অসুখ-বিসুখ...


 আমি ছাতা খুঁজতে খুঁজতে

 কখন নিজেই নিজের ছাতা হয়ে গেছি!


  ৩

চরিত্র


বিশ্বাস সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে

 অবিশ্বাসের দিকে চলে যাচ্ছে

 সিঁড়ির নিচে আমরা দোলাচল


 সবাই চরিত্র বিক্রি করছে

 আমরা শুধু খণ্ড খণ্ড চরিত্র সেলাই করছি

 আমাদের চরিত্ররা বাউল হয়ে যাচ্ছে


 এই মায়াভুবনের মানববাগানে

 কামনার বিসর্পিল সর্পগুলি

 শুধু গর্ত খুঁড়ে চলেছে সীমাহীন অন্ধকারের দিকে



October 10, 2021

তৈমুর খান

গুচ্ছ কবিতা

১.

রোদ পড়ে গেলে 


যা কিছু বলার ছিল 

সব পাপ 

দুধ পান করে করে

কখন বড়ো হয়ে গেছে 

ভোরবেলার সাপ 


এখন নিশ্চুপ বারান্দায় তাকিয়ে থাকা 

দূরকে কাছে ডাকা 


রোদ পড়ে গেলে অন্ধকারের হাতে হাত 

নগ্ন ছোবল শুধু, দু এক পেগ্ বিমূঢ় মদ 


          ২

শুধু বিজ্ঞাপন


মূর্খের সন্তান 

বাতাপি লেবুর গন্ধে জাগে 


কোকিলের ইংগিত তার মঙ্গল কাব্য 


জলাশয় থেকে ভোর তোলে 


একটি ঢেঁকির কল্পনায় 

সম্পূর্ণ পাড়া গাঁ 

নবান্নের স্বপ্নে দোল খায় 

তারপর রেললাইনের দিকে আনমনে হাঁটে 


ধোঁয়ামাখা মুখ কার ? 


ধান দূর্বার মুখ মুছে গেলে 

শুধু বিজ্ঞাপন হাসে 

               ৩.

 মৎস্যরমণী


চোখ সরাও, কল্পনাকে দেখি 

আলতামাসির পর এই প্রথম রমণী 

আকাশী রঙের শাড়ি পরে দোলায় মাথার ত্রিপল্লি বেণী 

চার প্রহর কেটে গেলে ডুবজলে এখনও আগুন 

মাছগুলি চেয়ে আছে, ঢেউ ওড়াচ্ছে 

আলগোছে সুর তুলছে, তাদের মুখে জলবাঁশি 


         ৪.

 অজ্ঞাত 


এক একটি রঙিন চিতা জ্বলে উঠলে 

করুণ চিৎকারগুলি নিভে যায় 

মেঘ সমাগমে সূর্য গুটিয়ে নেয় রোদ 

যদিও রোদের ভাষা তখনও থেকে যায় এবং

কার ঘর সংসার ভেঙে বয়ে চলে যুগ ? 

যুগের গুহায় লুকিয়ে থাকি 

শ্রীরামকৃষ্ণ ভোর ভোর জবা তুলে নেয় 


জবা কি সারাতে পারে সেসব অসুখ ? 


  ৫

ক্রমশ উদ্বাস্তু দিন


এরাও মানুষ ছিল

অন্ন বস্ত্র প্রেম আর স্বপ্নের পাখি পুষে

প্রতিরাতে ঘুমোতে যেত নারীর পাশে


সন্তানের জন্ম দিতে দিতে

পার করে দিত সব আয়ু

আজ শুধু ঘরের দরজায় হাহাকার

এঘর তাদের ঘর নয়

এদেশ তাদের দেশ নয়

সীমাহীন আকাশ ভেঙে পড়েছে মাথায়

কোথাও যাবার রাস্তা নেই


তাহলে জীবন, তুমি কীভাবে বাঁচতে চাও আর?

আর কী শুনতে চাও নতুন সমাচার?


ওই তো মানবিক রাষ্ট্র আজ আর মানুষের নয়

ক্রমশ বিদ্বেষ এসে আস্ফালন করে

ক্রমশ উদ্বাস্তু দিন নামায় অন্ধকার..


৬.

অবকাশ 


আমার অবকাশকে কখনো ঘুমোতে দিইনি 

খাঁ খাঁ শূন্যের ভেতর সে ছুটছে 

ম্লান হয়ে আসা দুপুরের উঠোনে 

আজও আমি উৎসাহ ছুঁড়ে দিচ্ছি


নিস্তব্ধতার হাততালি বাজছে 

মুহুর্মুহ ঘুঘু ডাকছে 

জল গড়িয়ে যাচ্ছে অন্যজলের দিকে 


আমি নতুন কিশলয়ের বার্তা এনে তাকে দিচ্ছি


হাসো অবকাশ , বিচ্যুতির ক্লাসে গরম আবহাওয়ায় 


নিরাভরণ সময়ের দোদুল সীমানায় 

কে কার কার সাথে শুয়ে যাচ্ছে এখন 


আর ঘুমের ভেতর নরম মাংসের স্বাদ


উচ্ছ্বাসগুলি ঝাঁক ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে

বিক্রমশীল নদীর দিকে সংকল্পের শিহরনগুলি 

শ্যামলমায়ায় ছলছল ছবি হয়ে যাচ্ছে 

ঘনীভূত মেঘে লুকিয়ে যাচ্ছে দানা দানা অনুভূতি


      ৭

দুর্জয় চাঁদ    


কল্লোল ভেসে যাচ্ছে রাস্তায় 

আমাদের কথারা নৌকার বিশ্রামে 

দুলছে 

কোথাও যাচ্ছে না 

রোদমাখা বাতাসে ধূসর পাঞ্জাবি 

উড়ছে 

অবেলার গার্হস্থ্য বিলাপ শুধু 

ছায়াদের নোনতা বিষাদ জমে আছে 


বাইরে নিয়ে চলো প্রজ্ঞা 

অনুভব অনুর্বর বলে 

আমরা শুধু ঈশ্বর আর ধর্মোৎসবে 

ক্লান্ত হই 

আমাদের অন্ধকারগুলি 

তমসার খ্যাতির আড়ালে 

কোনও নিয়তির চাঁদ খুঁজে ফেরে 

বড়ো দুর্জয় চাঁদ 


      ৮.

মঞ্চে মঞ্চে অদ্ভুত নাটক


 কিছু কি হারাচ্ছি রোজ ?

রঙিন শহরের রাস্তায়

দুরু দুরু বুক

আলুথালু চাহনি আমার

অসম্পূর্ণ মানুষ মনে হয়

হৃদয় গড়াচ্ছে কংক্রিট 

মায়াময় উষ্ণ নাভির স্রোত

ভাসিয়ে দিচ্ছে আমার সংগৃহীত মূল্যবোধ।


শূন্যে পাক খেতে খেতে

মঞ্চের দিকে চলে যাচ্ছি 

মঞ্চে মঞ্চে অদ্ভুত নাটক


কিছু কি হারাচ্ছি আমি ?

আমার পোশাক কেড়ে নিয়ো না শহর

সম্ভ্রমটুকু থাক

নিজেকে নিজের মতো দেখি

আমার ভিতরে আমি গ্রামকে বাঁচাই !


  ৯.

 নির্ঘুম পাথর


এখানে তেমন জায়গা নেই ,দাঁড়ানো যাবে না

তবু কেন ঘুমোবার সাধ জেগে উঠে ?

স্বপ্ন আসতে চাইছে বলে

মনে মনে নিত্য আয়োজন


কোলাহলের প্রাচুর্যের ভেতর থেকে 

নিজেকে টেনে নিয়ে এখানে এসেছি

এখানেও ব্যাভিচার পড়ে আছে

মৃত স্বপ্নের ভ্রূণ, ভ্রূণের হাহাকার

হৃদয়ের নিরীহ অশ্রুপাতে ভেজা মাটি


এখানে কি সুস্থতা থাকে ?

সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যাওয়া

শূন্যতায় ঘুরপাক খেতে খেতে 

পাথর হয়ে যেতে থাকি 

নির্ঘুম পাথর এক


           ১০.

করুণ সংকল্পটি


বেশ নাচ্ নাচ্ মনে হচ্ছে পৃথিবীকে 

এত ঢেউ উঠছে, হাসির ফোয়ারা ছড়াচ্ছে 

আর কলকাকলির জোয়ার আনছে 

সকাল থেকেই উৎসবের মেজাজ 

আমার মৃতদেহ কোথায় রেখে যাব তবে? 


শকুনেরা মাংস ছোঁবে না, 

কীট পতঙ্গেরা ঘৃণা করবে 

আমার চেতনারাও কি তবে 

জল প্রবাহে মিশে যাবে না? 

এই মাটিতে শুয়ে শুয়ে রোজ  

বৃষ্টিকে ডাকি 

মেঘ আর বাতাসের বৈভবে 

নিজেকে সঁপে দিই 

তবু আনন্দযজ্ঞে আমার এই 

                  আহুতি ভয় 


কবি পরিচিতি : জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে। 

পিতা ও মাতা :জিকির খান ও নাওরাতুন। 

পড়াশোনা :বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি প্রাপ্তি। 

পেশা : উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক । 

প্রকাশিত কাব্য : কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) ইত্যাদি। 

পুরস্কার : কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার ও দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, কবি আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার ইত্যাদি ।

ঠিকানা : রামরামপুর (শান্তিপাড়া), রামপুরহাট, বীরভূম, পিন ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।




















          





August 29, 2021

গুচ্ছ কবিতা।।তৈমুর খান ।।

সমস্ত যুদ্ধের পর 


অনেক মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকা 

হেসে ওঠে মাঝরাতে 

কোনও পিয়ানোর সুরে 


খোলাচুল উড়ে আসে তার 

বুকের ভেতর থেকে জ্যোৎস্নার ফণা 

দেখি দেখি চাঁদ গলে গেছে সারা দেহে 


সমস্ত যুগের রক্ত বয়ে গেছে 

এই পথ প্রগলভ অতীত 

তবুও নিহিত এক মর্মের জানালা 


চেতনা ফিরে পায় মৎস্যমুখী মেয়ে 

আকাশে গহনে জলে লেখে আলপনা 

বিন্দু বিন্দু বেঁচে ওঠা ঘুম 


ঈশ্বর

লীলাকে ডাকিনি কাছে 

শরীরই ঈশ্বর হয়ে আমার শরীরে শুয়ে আছে


নিজস্ব ফাঁকা আস্তাবলে আজ কোনও ঘোড়া নেই 

সব ঘোড়া অশ্বিনীকুমার হয়ে গেছে 


প্রাচীন পৃথিবীর রহস্য-আলোয় জল খেতে এসে দেখি 

সব ঝরনায় আমারই ঈশ্বর হেসে ওঠে…. 


বাসরবাগান


সব ফুল ফুটবার আগেই 

সৌরভ এসে উপস্থিত হয়েছে বাগানে 

ফুলের দিকে তাকালেই 

                      জড়িয়ে ধরছে হাসি 

                             স্বপ্নের সেই পেলব পাপড়িগুলি 

এক একটি ইংগিত ডাকছে আমাকে 

আগাছার ভিড় ঠেলে 

লতানো গাছের বাহু ঠেলে

                         এগিয়ে চলেছি 

আজ ঘাসে ঘাসে শয্যা পাতা আছে 

পাতায় পাতায় আশ্চর্য কাহিনি... 


সৌজন্যে 


কোথাও কোথাও পরমজনেরা থাকে 

                                                       দেখা হয় 

                         তাদের সৌজন্যে আহ্লাদ পাই আমি 

দুঃখের ঘষা ঘষা দাগগুলি 

                                                   মুছে ফেলি 

                আর ক্ষত স্থান জুড়ে রক্তজবা ফোটাই                                 

শোকের ঝরনার তীরে 

                       কুসুম কুসুম সকাল হলে তার

           আনন্দের প্রতীক্ষায় রোদ খুঁটে খাই 


জলজ


নিজেকে ব্যঞ্জনা ছাড়াই তোমার কাছে উপস্থিত করি 

আমাকে স্পর্শ করো —


বয়স কি গোখরো সাপ ছুঁলেই ছোবল দেবে ? 


শ্যাওলা সরিয়ে দ্যাখো, স্নিগ্ধ জলের তলায় 

আমারই নিভৃত অঙ্কুরোদ্গম.... 


নষ্ট সিনেমা 


করতলে নদীর বিয়ানো চরাচর 

নৌকা চিহ্ন, বাঁশিব় জীবাশ্ম 

আর খাঁ খাঁ শূন্য বিস্ময় 


বিমূঢ় যুগের ছবি 

ক্যামেরায় সাঁতার দিচ্ছে 


বিকল্প শিকারি এসে শুরু করছে অন্ধবিপ্লব 



কবি পরিচিতি : জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে। 

পিতা ও মাতা :জিকির খান ও নাওরাতুন। 

পড়াশোনা :বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি প্রাপ্তি। 

পেশা : উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক । 

প্রকাশিত কাব্য : কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) ইত্যাদি। 

পুরস্কার : কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার ও দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, কবি আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার ইত্যাদি ।

ঠিকানা : রামরামপুর (শান্তিপাড়া), রামপুরহাট, বীরভূম, পিন ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।










          

July 31, 2021

তৈমুর খান

গুচ্ছ কবিতা

১.

যুগের প্রচ্ছদ


অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছি 

পিতার আকাশে অনেক নক্ষত্র ঝরে গেলে 

অন্ধকারের ছায়ায় ব্যক্তিত্ব উঁকি মারে 

কেমন করে ডাকব নিজেকে ? 


সামনাসামনি নীরব ও আমি 

চেয়ে আছি সুদূর চৈতন্য পারে 

আজ কোনো গল্প নেই 

গল্পরা চরতে গেছে মাঠের অন্ধকারে 


এক একটি বাইরের তরঙ্গ 

নোনতা ফাগুনের সংবাদে 

আমাকে ভেজাতে আসে —

দীর্ঘ ফণায় তাদের সম্মোহন কাঁপে 


দরজা খুলি । সমস্ত ক্ষয়ের চিহ্নগুলি 

যুগের প্রচ্ছদ । 

অস্তিত্ব নেই । শব্দের দেয়ালে 

সময়ের নিরর্থ নির্দেশ । 


২ 

ভোর 


মৃত্যুর কলোনিতে ভোর এল 

জেগে উঠছে মৃতেরা এবার 


রোদ্দুরেরা শাড়ি মেলছে 

কাকলিরা বসাচ্ছে বাজার 


নাচের স্কুল খুলে দিয়েছে হাওয়া 

পাতাদের কানাকানি 

                        ভ্রমরদের শুরু আসা-যাওয়া 


যার জন্য 


কার কণ্ঠস্বর ? 

ভ্রমের তুলনা ভেঙে ভেঙে 

সত্যেরও অপলাপ হয় 

দীর্ঘ ছায়ার গাছে 

যদিও অনবদ্য কুসুম ফোটে 

কুসুম কি জানে সুখ ? 

যার জন্য সমস্ত বিকেল গেল 

যার জন্য স্বপ্নেরা শুকনো কিংশুক 


শ্রীনিরপেক্ষ 


চারিপাশে নীল মাছ 

বুড়বুড়ি তুলছে 

আমি কেন তাদের মতো হব ? 


চারিপাশে মাছধরা লোক 

টোপ ফেলে বসে আছে 


আমি কেন সবার মতন টোপ খাব? 


জলে অন্তর্বাহী স্রোত 

বিষণ্ণ শ্যাওলার কাছে 

আমি নিরপেক্ষ হতে চাই 


যদিও এখানে বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়া যাবে না কখনও 


বাসা বদল


বাসা বদল করার কথা হচ্ছে ঘন ঘন 

এবার কোন্ বনে যেতে হবে… 


সবকিছু বুঝে তারপর 


জীবনের ইতিবৃত্ত অলিখিত রেখে 

একটা শ্লেট শুধু 

সাদা পেন্সিলে ভর্তি করতে চাই 


বাসা বদল হলেও হৃদয় বদল হবে নাকো 

  ৬

অনুভূতি 


তোমার হাতের ছোঁয়াটুকু 

লেগে আছে শরীরে আমার 

আমি তাকে অনুভূতির অ্যালবামে রাখি 


প্রতিটি বসন্তে পাতা ঝরে গেলে 

তাতেই ফোটাতে চাই নতুন মঞ্জরী 


অনুভূতির মৃত্যু নেই 


প্রাচীনত্ব নেই 


অনুভূতি রোজই এসে দরজায় দাঁড়ায় 

                                        নতুন কিশোরী 



        ৭

আমাকে বৃষ্টির ভেতর রাখো 



আমাকে বৃষ্টির ভেতর রাখো 

সময়ের কোলাহলে হুলস্থুল পাড়া 


আগুন জ্বালায় কারা ? 


তির-ধনুক ছুটে আসে 

মঞ্চে মঞ্চে যুদ্ধের মহড়া 


দিন যায় । মাইকে ঘোষণা হয় 


নাম পরিচয় 

সামনে আলোর বৃক্ষ 

মনীষীদের নাম লেখা পাতায় পাতায় 


এক একটি নামের কাছে এসে 

খুঁজতে থাকি কোথায় করুণা 

হৃদয় কোথায় থাকে 


হাত বাড়ালেই হাত কাছে আসে কিনা 


আমাকে বৃষ্টির ভেতর রাখো 

বিশ্বাসও অসহ্য এখন 

মরে গেছে সব সান্ত্বনা ! 


 

ধ্বংস বেশ বাজনা বাজাচ্ছে


মৃত মানুষের ভিড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে 

সদ্য রক্তপাত আর যন্ত্রণার চিৎকার 


কোন্ দিকে যাব ? 


ধ্বংস বেশ বাজনা বাজাচ্ছে 

সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অন্ধকার 


কোথাও যাওয়ার নেই 


চকচকে কাদের উলুধ্বনি ? 

অস্ত্রের বিবাহ অস্ত্রের সাথে 


ধর্ষক দাঁড়িয়ে আছে ঈশ্বরের মতো 

ধর্ষকের পায়ে কারা ফুল রাখে ? 


কোথাও রাস্তা নেই 


সভ্যতা কাঁপে এক বিস্ময়ের জ্বরে.... 


       ৯

বিষাদের দেশে


বিষাদের দেশে সন্ধ্যা এল 

ভাঙা তোরঙ্গগুলি থেকে 

আমাদের নিঃশেষ মূলধন

অবলুপ্ত হবে। 


সাংসারিক ক্রিয়ার আলো 

গৃহে গৃহে জ্বলে 


গৃহিণীরা হৃদয় আগলে রাখে । 


বস্তু পৃথিবীর চাঁদ উদিত হলে 

কী নামে তাকে ডাকা হবে ? 

ভাঙা তোরঙ্গগুলি নিঃস্ব ইতিহাস... 


       ১০

        কলসি


পর্দা সরিয়ে নিলেই দেখি ছায়ার বাঁশি বাজে 

দু একটা জোনাক ওড়ে, আগুনের দানা দানা 

রূপকথাগুলি ওড়ে 

সহিষ্ণু পাথর হয়ে বসে থাকে কাঙাল স্বপ্নেরা 


তবু রথ চলে, ৠতুমতী নারীর কঙ্কণ বেজে ওঠে 


ফিরে দেখি একাকী দাঁড়িয়ে আছি ঘাটে 

কলসি একা ভেসে গেছে দূর 

ও পাড়ার নতুন তরঙ্গের কাছে 


    ১১

মরীচিকা 


মরুর পাহাড়ে প্রথম সঙ্গমদৃশ্য লেখা হলো 

অভাবী ঘরের চাঁদ নরম স্তনের মতো 

দূর থেকে ছুঁয়ে দেখা 


দু একটা হরিণ শুধু ছুটে যায় 

বাঁকা ও কাতর শিঙ্ তুলে 

ব্যথাতুর ঝরনার খোঁজে…. 


নিজেকে সামলে নিই 

এইসব দৃশ্য বড় আবেগ মেশানো 


রোদের ভাষায় লেখা অলীক নাটক 

যদিও বাস্তব কিছু দৌড় সারাদিন 

শোনায় পদধ্বনি… 


    ১২

শিকারি


শাদা বক হয়ে দিন বসে থাকে জলে 

জলের ভেতরে জটিল মাছের গান শোনে 

দু একটা স্বরলিপি তুলে নেয় ঠোঁটে 


কেননা, তারও জীবিকা আছে সময়ের স্রোতে 

রক্তমাখা উল্লাস আর জৈব তাড়না 

মাঝে মাঝে উন্মনা করে দ্যায় তাকে 

জল তবু দেহ ঢেকে চলে যায় জলে 


শিকারির ধ্যান বাড়ে সকালের প্রত্যাশায় 



কবি পরিচিতি : জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে। 

পিতা ও মাতা :জিকির খান ও নাওরাতুন। 

পড়াশোনা :বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি প্রাপ্তি। 

পেশা : উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক । 


প্রকাশিত কাব্য : কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) ইত্যাদি। 

পুরস্কার : কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার ও দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, কবি আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার ইত্যাদি ।

ঠিকানা : রামরামপুর (শান্তিপাড়া), রামপুরহাট, বীরভূম, পিন ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।





June 30, 2021

তৈমুর খান

কাঙাল গ্রীষ্ম



তালপাতার পাখা দাও

আজ বাতাস নেই, রুক্ষ গ্রীষ্মকাল

টুকরো টুকরো ছায়ায় আমাদের নষ্ট বিশ্রাম

অপেক্ষায় আছে


ঝড় উঠবে,

ঝড়ে উড়বে গোধূলির গান

মেহগনি পাতারা ছোঁড়ে মর্মর কাঁপন


ঠাণ্ডা জল, একটু এদিকে এসো

কী সুন্দর গ্লাস !

তৃষ্ণা আজ কিছুতেই কথা শোনে না

ডাকছে, ডাকছে তোমাকে 

তুমি বসন্তের নতুন কিশোরী হও !




বর্ষারঞ্জিনী



ছোট্ট বাড়ি, মা হলুদ বেটে দেয়

আমরা নিমপাতা চিবিয়ে দেখি

তেঁতুল গাছের বক ওড়ে

উঠোনে ছায়া পড়ে হাসে


রোজ দেখি মেঘদূত যায়


আমাদের ছেঁড়া বর্ণ পরিচয়

প্রতিটি সকাল চেনে,

বিদ্যাসাগর এসে দেখে যান

পাঠশালা বসে গাছের ছায়ায়


মেঘদূত, বৃষ্টি হবে না আজ ?

বাবা নেই , মা শুধু কাঁদে


আঁচল ভিজে যায় মায়ের কান্নায় !




যুগান্তর পথ 


তোমার কুয়ো থেকে দুঃখ তুলে নিচ্ছি 

আমার ভাবনার রশি দীর্ঘ ঝুলে নামছে 

কুয়োর পাতালে 


একাকী লণ্ঠন জ্বেলে আকাশরঞ্জিনী পতঙ্গদের 

                                                      ডাকছি 

ডানা পুড়িয়ে যাক তারা 

মৃত্যুর কি ভাষা আছে  ? 

ভাষাহীন মরে যাওয়াগুলি আমার সন্তান 

নিষিদ্ধ প্রান্তরে তাদের কবর দিই আমি 

আর মধ্যরাতে কবর থেকে তুলে 

                                তাদের প্রাণ ফিরিয়ে দিই 


বাঁচা - মরার ভেতর দিয়েই যুগান্তরের পথ 

দাঁড়ি - কমাবিহীন বয়ে যেতে থাকে অনিঃশেষ 






March 28, 2021

তৈমুর খান

 উড়ন্ত জোকারের হাসিতে দার্শনিক চেতনা


নব্বই দশকেই বাংলা কবিতার যে নতুন পর্ব শুরু হয়েছিল তার চূড়ান্ত রূপ ফুটে ওঠে শ্রীজাতের কবিতায়। সমাজ এবং ব্যক্তিগত দুই পারিপার্শ্বিক নিবিড় ক্ষেত্র থেকে শিল্পী তাঁর জগৎ খুঁজেছেন। শব্দ, উপমা, মাত্রা, পর্ব, মিলের অভিঘাত যেমন বাহ্যিক প্রকাশে ধ্বনি সাম্যের অনন্যতা এনেছে, তেমনি বুদ্ধিদীপ্তির সঙ্গে আত্মরসায়নের স্বচ্ছন্দ অনুঘটন এক মৌলিক রূপটানে উপস্থিত হয়েছে। শ্লেষ, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সঙ্গে আত্মতার ঘোর অভিনিবেশ সাবলীল ও সরাসরি আত্মপ্রকাশে কবিতা সজীব, প্রাণময়। সেখানে ভাঙচুর ঘটেছে, বক্রোক্তি বিরোধাভাসে জীবনের অনেক নঞর্থক শূন্যতা ধরা পড়েছে, তবু শেষ পর্যন্ত সদর্থক অস্তিবাদকেই খুঁজে পেতে চেয়েছেন। যে জীবন নিয়ে শ্রীজাত জন্মেছেন, যে পরিবেশ পরিস্থিতি তাঁকে বিচলিত করেছে, যে স্বপ্ন-চপলতা তাঁর দরজা খুলতে চেয়েছে, যে নারী-বন্ধুত্ব তাঁর মনোযোগ দাবি করেছে–

সেসব সম্পর্ককে তিনি আড়াল করেননি। জীবনের টানাপোড়েন অভাব-শূন্যতাকে আত্মস্থ করেই কামে-প্রেমে-স্বপ্নে-ভোগে-ত্যাগে জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছেন। নিজের অতীত আর বর্তমানকে নিয়েই তাঁর যাত্রা, ভবিষ্যৎ নয় মুহূর্তের আবেগে যতদূর নিজের ছায়া দেখতে পান, ততদূরই হাত বাড়ান, আর ততদূরেই উঠে আসে সময়ের স্বরলিপি। তাঁর ক্ষতগুলি উন্মোচিত হয়। গোপনতা প্রকাশিত হয়। নিজের প্রতি যেমন নির্মম, তেমনি সদয়ও। যে পথে ঠেলে দেন তা সবসময় সুখের নয়, দুঃখেরও, চোখের জলের, বেদনার এবং বিস্ময়েরও। এক কৌতুকের ভেতর দিয়ে পাঠককে নিয়ে যেতে চান, কখনো রূপকের ভেতর দাঁড়িয়ে থেকে সম্পর্ক নির্ণয় করেন। ব্যক্তি অনুভবের বারান্দায় চাঁদ-পৃথিবী-আকাশ-মাটি-গান এবং স্তব্ধতাও কবির সত্তায় অনিবার্য ভূমিকা হয়ে ওঠে। স্বপ্নের বিভূতি জাগরণের নিঃশ্বাসে পা-তোলা পা-ফেলা জীবনের ছন্দ-মুগ্ধতায় মিশে যায়। আত্মা শরীরের কাছে ধরা দেয়, ভাবনা মনের ফসলে  ফলে ওঠে, ব্যক্তির নিরিখে মানব-রস পরিবেশিত হয়। আদিরস কখনো কটুকথার তিক্ততায় ভরা, কখনো রসিকতায় হালকা, নাগরিক ভদ্রতায় সলজ্জ, কখনো আলাপী নিষ্ঠাবান। কিন্তু সবক্ষেত্রে কৃৎকৌশলে ধোপদুরস্ত, বিন্যস্ত, সুন্দর ও স্বভাবদক্ষ।


     'উড়ন্ত সব জোকার' বইয়ের ভূমিকায় শ্রীজাত জানিয়ে দিয়েছেন:

'এবার খেলা অন্যরকম হোক–

 জলখাবারের-গল্প শুনুক লোক

 তেল-আগনের কাছে।'


      তখন বুঝতে পারি আঁশবটিতে কুচিয়ে নেওয়া চাঁদের সঙ্গে আড়াইশো গ্রাম লাল-নীল আহ্লাদের কীরকম রান্নাবান্না। তারপরেই টাটকা কিছু ক্ষতও পরিবেশন করেন তার সঙ্গে। প্রতিনিয়ত আমাদের ব্যক্তি-অবয়ব যেভাবে কুঞ্চিত, দীক্ষিত এবং বিভক্ত হয়ে পড়ছে তাতে ঐতিহ্য উত্তরাধিকার এবং ধারাবাহিক বিশ্বাস বজায় রাখা কঠিন। তখনই অন্যতর খেলায় নামতে হয় আমাদের। জীবনকে অন্যভাবে পরিমাপ করতে হয়। তেল-আগুন দুই-ই দাহ্য-দাহক, অস্তিত্বের নিঃশেষ নির্যাস সেখানেই। বেঁচে থাকাটাই জলখাবারের গল্প। সুতরাং বিশেষণও তার জায়গার বদল করে। উপমানও উপমেয় হয়ে যায়। ক্রিয়াও তার বাহ্যিক  ক্রিয়া হারিয়ে ফেলে।কর্তাটি বিভক্ত মানুষ। সমস্তই ডিগবাজি খাওয়া উড়ন্ত জোকার। সেসব জোকারের হাসি তামাশায় কখনো কখনো দার্শনিক উক্তিও বেরিয়ে আসে :

'জীবন কিন্তু প্রেমদিওয়ানা, সাবধানে তার গায়ের গন্ধ শুঁকো–

বলছে আমায় উড়ন্ত দুই পাগল। জোকার দেরিদা আর ফুকো।'

                      (উড়ন্ত সব জোকার)


    এই প্রেমদিওয়ানা জীবনের কথাই বারবার ফিরে এসেছে প্রতিদিনের জীবনে। 'রঞ্জিনীকে লেখা চিঠি'তে রবীন্দ্রনাথের 'আকাশ ভরা সূর্য তারা' ব্যক্তির অকৃতকার্যতায় 'ঢপের আকাশ, সূর্য, তারা…' হয়ে যায়, আর সেই কারণেই 'স্বপ্নগুলোও বাস্তুহারা'। সুতরাং প্রেমের ইতি টেনে নিজেকে 'ফালতু লোক' বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তবু প্রেমকে বারবার শুঁকেছেন। দেহের স্বাদেই তাকে পেয়েছেন। ইন্দ্রিয়েই উপলব্ধি করেছেন– এরকম বোধ থেকেই লিখেছেন:

'এখনও লোক হাঁপায় আর টিকটিকিরা দেয়ালে মাথা কোটে

 এখনও প্রেম জনপ্রিয়। এখনও টবে গোলাপফুল ফোটে…'

                                      (ধর্ম)

           আর এই জন্যই কবি'র স্বীকারোক্তি:

'তোমার কথা ভাবলে আজও পুরুষাঙ্গ শক্ত হয়ে ওঠে'

           'ছোটদের চিড়িয়াখানা' বইয়েও কবির অনুভব:

 'দেখি জীবন কত ছোট'

 বলেই জীবনকে ভোগের নেশায় নামিয়ে দেন। কিন্তু ভোগের মধ্যেও সুখ থাকে না। 'চুমু বিষের চেয়েও তেতো….' হয়ে যায়। তখন সবই জৈবনিক, মানিয়ে নেওয়া জীবনের অভ্যাস ফিরে আসে। অলীক অবস্তুতে মিইয়ে যায় প্রাকযৌবনের স্বপ্ন:

 'আচার ভেবে চেখেছিলাম ক্ষত

 তুমিও চুমু ভাতের সঙ্গে খেতে

 এখন আমি কারিগরের মতো

 ছাইয়ের ঘর বানাই অ্যাশট্রেতে'

                           (ছেড়ে যাওয়া)


      প্রেমে আঘাত অভিযোগ সবই থাকে, থাকে বিচ্ছেদও। গরম-ঠান্ডা সম্বন্ধ। তবুও অভাবের দিনে চুমু খেয়েই বেঁচে থাকা যায়। কিংবা নাসির-শাবানা হয়েই থাকা যায় একটু দূরে দূরে। সব সময় সহজ লোকের মতো সবকিছু স্বাভাবিক ঘটবে তা তো নয়। ছন্দের মাত্রা বাড়া কমার মতোই জীবনও ঢালু পথ ছেড়ে উল্টো পথেও এগিয়ে যায়:

'খ্যাপা উল্টো স্রোতেই সাঁতরায়

 তার দু'মাত্রা তিন মাত্রায়

 কিছু যায় আসে না আজকাল'

                               (প্রেমপর্ব)


       এভাবেই 'ভোলামন পোস্টমডার্নিয়া' গেয়ে চলেছেন 'সন্দেহ তত্ত্বের গান'। নিজেকে নিজের মতোই উপস্থাপনা করেছেন। দেশ-কালের অসামঞ্জস্য পরিস্থিতিকে আত্মস্থ করেই সাময়িকের আরাম আহ্লাদেই তাঁর প্রাপ্তি বুঝে নিতে চেয়েছেন:

'এসো আমরা ঘুমোই একটু

এই শেষবার জড়ামড়ির অসহ্য আহ্লাদ

পায়ের নীচে ফালতু মাটি

      মাথার ওপর টেম্পোরারি চাঁদ…'

                              (জাজমেন্ট ডে)


    প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকেই দেখেছেন মন্দ কপাল, প্রতারক, যৌনব্যবসায়ী. নিঃসঙ্গতা– আর সে-সবই প্রাত্যহিক জীবনের এক-একটি প্রচ্ছদ, কাহিনির প্রেক্ষাপট। তখন মনে হয় এসব রঙ্গও আমাদের সভ্যতার ভঙ্গুর ছায়াচিত্র যা প্রতিনিয়ত ধ্বসে পড়ছে আর আমাদের অভিযোজন ঘটছে:

'সামনে রাস্তা।জল আগুনের কেচ্ছা

অন্ধকে পথ বাতলে দিচ্ছে বেশ্যা'

                                    (রওনা)


         বেশ্যার জীবনের পথ যেখানে রুদ্ধ, অন্ধও সেই বেশ্যার চোখে পথ দেখছে– এ যেমন স্বচ্ছ নয়, তেমনি অসম্পূর্ণও। সভ্যতার এই নিরবচ্ছিন্ন যাত্রায় কবিরও সদ্গতি এই কবিতাটির শেষ দুই চরণে:

'জানালা হাঁ মুখ। দেয়াল ভর্তি সাপখোপ…

নতুন বাড়ি, নতুন করে থাকব।'


     এখানেই জীবনকে মানিয়ে নেওয়া অথবা ভালোবাসা দুইয়েরই দেখা মেলে।


         বাস্তব সময়ের পরিধি কীভাবে আমাদের গ্রাস করেছে; মৃত্যু ধর্ষণ সন্ত্রাস প্রতিমুহূর্তে খবর তৈরি হচ্ছে; কত রকম টিভি চ্যানেল, প্রতিহিংসার এক ঝগড়ামাখা পৃথিবীর রূপ দেখতে পাচ্ছি চারিদিকে। বস্তা থেকে কাটা মুন্ডু বেরোচ্ছে। এসব দেখতে দেখতে টিউশনির রোজগার শূন্য ব্যক্তিটি নিজের কাছে ধরা পড়ে যান। তখন লিখতেই হয়:

 'শান্তি নেই। শান্তি নেই। শান্তি

 চাঁদের মতো কাটামুন্ড উঠেছে,

            উঠেছে কালো আকাশে…'

                                (প্রতিহিংসা)

       ঝলসানো রুটিৱ থেকেও ভয়ঙ্কর এই চাঁদ। উপমেয়টিই উপমান হয়ে গেছে এখন যুগের প্রেক্ষিতেই। পর্যবেক্ষণেরও এক সূক্ষ্ম মননে শ্রীজাত আমাদের ভাবিয়ে তুলেছেন।


        শুধু আড্ডাবাজ আত্মকথার ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি; হই-হুল্লোড় দিনলিপির ভেতর থেকেও বেড়াল, সিংহ, সাপ, মুরগি,  ব্যাঙ, প্যাঁচা, বাদুড়, হায়না, বাঘ,পিঁপড়ে, কচ্ছপ, কুকুর, জেব্রা প্রভৃতি প্রাণীর রূপকে নিবেদন করেছেন নানা তথ্য। জৈবিক প্রবৃত্তির টানে সেসব নির্ণীত চরিত্রগুলির ভেতর নিজেও দাঁড়িয়েছেন। আত্মস্বরূপ উন্মোচন করেছেন। কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছেন, কিংবা কীভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন তারও পরিচয় আছে। ছোটদের চিড়িয়াখানা তখন বড়দের এক-একটি আবিষ্কারে ভর্তি হয়ে গেছে। রূপকগুলি কী বলছে তার কয়েকটি নমুনা:

 সিংহ :

 'ঘুমন্ত, আমি ঘুমন্ত,

 আমি ঘুমন্ত

        তবু সিংহ!'


 মুরগি:

 'আমরা কিন্তু এই বাজারেও

 সস্তা এবং দারুণ খেতে!'


 ব্যাঙ:

 'ভেজা আড্ডা

 দুটো বন্ধু

 লোকে বলছে

 কূপমণ্ডুক ' 


 হায়না:

'যেমন আমি রক্ত চাটা শিখছি, তবে আস্তে

ওরও একটু সময় লাগবে ঘড়ির কাঁটা বাছতে…'


 বাঘ:

'এখন কী আশ্চর্য, আমার গায়ে, আমার মুখে,

আমার চলাফেরায়, অবিকল বাঘের গন্ধ।'


 কুকুর:


'আমিও কেমন কুকুর হয়ে গেছি

চাটার আগে শুঁকে দেখছি তোমায়'


        এভাবেই চিড়িয়াখানার জন্তু জানোয়ারেরা মানুষ হয়ে উঠেছে। এক-একটি চরিত্র লাভ করেছে আমাদের সমাজে। যাদের খুব চেনা, খুব কাছের ও বহুবার দেখা মনে হয়। এসবই উঠে আসে কবিতায়।


            অন্ত্যমিল, পর্বমিল এবং শব্দ ব্যবহারে ধ্বনিসাম্যের বহু  পরীক্ষা-নিরীক্ষাও শ্রীজাত  করেছেন। সব মিলিয়ে এমন এক অভিঘাত আমাদের দোলাতে থাকে, যাতে কবিতাপাঠে বিরক্তি আসে না, বরং দ্রুততার সঙ্গে এক গতিময় ধ্বনিঝংকারে ঝরনায় স্নান সেরে উঠি। 'বর্ষামঙ্গলে'র কবিতাগুলোতেও 'খুশিমাছ, ডিমের বিরহ' পড়তে পড়তে বাংলা শব্দার্থের এমন ব্যবহার আছে জানতে পারি। খুব সহজভাবেই শ্রীজাত আমাদের মরমে প্রবেশ করেন, আর মিলে-ছন্দে-সুরে আমাদের অমিলকে সুন্দরতায় ভরিয়ে তোলেন। জীবন ও জীবনের বৈপরীত্যকে নাড়িয়ে তোলেন।











February 28, 2021

তৈমুর খান

 বিশ্রাম 

অনেক বিপ্লবের দিন কেটে গেলে 

আমরা নিরিবিলি খুঁজতে বেরিয়েছি 

অনেক মৃত যুগ পার হয়ে 

একটি ধূসর যুগে আজ 


এখানে চিৎকারগুলি পড়ে আছে 

হাওয়া আজও ক্রন্দনধ্বনি বয়ে আনে 

রক্তঘ্রাণে মৃতদেহগুলি হাঁটে 

আমরা ছায়া খুঁজি 

অনেক নীরব ছায়ার কাছে 


পাখিদের পাঠশালা, নদীর দোকানে 

আর অরণ্যের সবুজের কাছে 

আমরা কিনতে চেয়েছি বিশ্রাম 


বিশ্রাম পাওয়া যায় ? 


বিশ্বাসী নূপুর বেজে উঠুক তবে 

কাছে এসে হাত ধরে বসুক 

আমরা অপেক্ষায় আছি… 









October 25, 2020

তৈমুর খান

 মাটিতেই বসে থাকি 

সব পাখিরা উড়ে যাচ্ছে 
কথা বলতে এসেছিলাম পাখিদের সাথে 
কথারা পাখিদের পিছনে পিছনে ছুটেছে 

পৃথিবীতে কেউ নেই আমার কথা শোনার 
গাছেরা দিগন্ত ছুঁতে চায় 
পর্বতেরা দেমাকে অটল 
নদীরা তো নাচে শুধু নিজের গৌরবে 

মা নেই 
কাঁদতেও ইচ্ছে করে না 
কার কাছে রাখব অভিমান ? 
দিগন্ত দূরের দেশ আমার ভাষাও বোঝে না 
মাটিতেই বসে থাকি সারাদিন 
এই শতাব্দীর রক্তে ভেজা মাটি… 


নীরেন্দ্রনাথ 

তোমার বাতাসি ডেকে ডেকে চলে যায় 

বাস থেমে গেলে আমরাও নামি 
সামনে অন্ধকার হয়ে আসে পথ 

দীর্ঘ ছায়া পড়ে 

কার ছায়া সংকেতের ভিতরে বাহিরে? 

আমাদের বাস্তবের বাড়ি 
সেখানেই ফিরে যেতে চাই 

তুমি তো নীরেন্দ্রনাথ 
এই চক্রবর্তী পাড়ায় আমরা ঘুরি চক্রবৎ 

গুচ্ছ কবিতা।।তৈমুর খান ।।

সমস্ত যুদ্ধের পর   অনেক মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকা  হেসে ওঠে মাঝরাতে  কোনও পিয়ানোর সুরে  খোলাচুল উড়ে আসে তার  বুকের ভেতর থেকে জ্যোৎস্নার ফণা ...