October 10, 2021

তৈমুর খান

গুচ্ছ কবিতা

১.

রোদ পড়ে গেলে 


যা কিছু বলার ছিল 

সব পাপ 

দুধ পান করে করে

কখন বড়ো হয়ে গেছে 

ভোরবেলার সাপ 


এখন নিশ্চুপ বারান্দায় তাকিয়ে থাকা 

দূরকে কাছে ডাকা 


রোদ পড়ে গেলে অন্ধকারের হাতে হাত 

নগ্ন ছোবল শুধু, দু এক পেগ্ বিমূঢ় মদ 


          ২

শুধু বিজ্ঞাপন


মূর্খের সন্তান 

বাতাপি লেবুর গন্ধে জাগে 


কোকিলের ইংগিত তার মঙ্গল কাব্য 


জলাশয় থেকে ভোর তোলে 


একটি ঢেঁকির কল্পনায় 

সম্পূর্ণ পাড়া গাঁ 

নবান্নের স্বপ্নে দোল খায় 

তারপর রেললাইনের দিকে আনমনে হাঁটে 


ধোঁয়ামাখা মুখ কার ? 


ধান দূর্বার মুখ মুছে গেলে 

শুধু বিজ্ঞাপন হাসে 

               ৩.

 মৎস্যরমণী


চোখ সরাও, কল্পনাকে দেখি 

আলতামাসির পর এই প্রথম রমণী 

আকাশী রঙের শাড়ি পরে দোলায় মাথার ত্রিপল্লি বেণী 

চার প্রহর কেটে গেলে ডুবজলে এখনও আগুন 

মাছগুলি চেয়ে আছে, ঢেউ ওড়াচ্ছে 

আলগোছে সুর তুলছে, তাদের মুখে জলবাঁশি 


         ৪.

 অজ্ঞাত 


এক একটি রঙিন চিতা জ্বলে উঠলে 

করুণ চিৎকারগুলি নিভে যায় 

মেঘ সমাগমে সূর্য গুটিয়ে নেয় রোদ 

যদিও রোদের ভাষা তখনও থেকে যায় এবং

কার ঘর সংসার ভেঙে বয়ে চলে যুগ ? 

যুগের গুহায় লুকিয়ে থাকি 

শ্রীরামকৃষ্ণ ভোর ভোর জবা তুলে নেয় 


জবা কি সারাতে পারে সেসব অসুখ ? 


  ৫

ক্রমশ উদ্বাস্তু দিন


এরাও মানুষ ছিল

অন্ন বস্ত্র প্রেম আর স্বপ্নের পাখি পুষে

প্রতিরাতে ঘুমোতে যেত নারীর পাশে


সন্তানের জন্ম দিতে দিতে

পার করে দিত সব আয়ু

আজ শুধু ঘরের দরজায় হাহাকার

এঘর তাদের ঘর নয়

এদেশ তাদের দেশ নয়

সীমাহীন আকাশ ভেঙে পড়েছে মাথায়

কোথাও যাবার রাস্তা নেই


তাহলে জীবন, তুমি কীভাবে বাঁচতে চাও আর?

আর কী শুনতে চাও নতুন সমাচার?


ওই তো মানবিক রাষ্ট্র আজ আর মানুষের নয়

ক্রমশ বিদ্বেষ এসে আস্ফালন করে

ক্রমশ উদ্বাস্তু দিন নামায় অন্ধকার..


৬.

অবকাশ 


আমার অবকাশকে কখনো ঘুমোতে দিইনি 

খাঁ খাঁ শূন্যের ভেতর সে ছুটছে 

ম্লান হয়ে আসা দুপুরের উঠোনে 

আজও আমি উৎসাহ ছুঁড়ে দিচ্ছি


নিস্তব্ধতার হাততালি বাজছে 

মুহুর্মুহ ঘুঘু ডাকছে 

জল গড়িয়ে যাচ্ছে অন্যজলের দিকে 


আমি নতুন কিশলয়ের বার্তা এনে তাকে দিচ্ছি


হাসো অবকাশ , বিচ্যুতির ক্লাসে গরম আবহাওয়ায় 


নিরাভরণ সময়ের দোদুল সীমানায় 

কে কার কার সাথে শুয়ে যাচ্ছে এখন 


আর ঘুমের ভেতর নরম মাংসের স্বাদ


উচ্ছ্বাসগুলি ঝাঁক ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে

বিক্রমশীল নদীর দিকে সংকল্পের শিহরনগুলি 

শ্যামলমায়ায় ছলছল ছবি হয়ে যাচ্ছে 

ঘনীভূত মেঘে লুকিয়ে যাচ্ছে দানা দানা অনুভূতি


      ৭

দুর্জয় চাঁদ    


কল্লোল ভেসে যাচ্ছে রাস্তায় 

আমাদের কথারা নৌকার বিশ্রামে 

দুলছে 

কোথাও যাচ্ছে না 

রোদমাখা বাতাসে ধূসর পাঞ্জাবি 

উড়ছে 

অবেলার গার্হস্থ্য বিলাপ শুধু 

ছায়াদের নোনতা বিষাদ জমে আছে 


বাইরে নিয়ে চলো প্রজ্ঞা 

অনুভব অনুর্বর বলে 

আমরা শুধু ঈশ্বর আর ধর্মোৎসবে 

ক্লান্ত হই 

আমাদের অন্ধকারগুলি 

তমসার খ্যাতির আড়ালে 

কোনও নিয়তির চাঁদ খুঁজে ফেরে 

বড়ো দুর্জয় চাঁদ 


      ৮.

মঞ্চে মঞ্চে অদ্ভুত নাটক


 কিছু কি হারাচ্ছি রোজ ?

রঙিন শহরের রাস্তায়

দুরু দুরু বুক

আলুথালু চাহনি আমার

অসম্পূর্ণ মানুষ মনে হয়

হৃদয় গড়াচ্ছে কংক্রিট 

মায়াময় উষ্ণ নাভির স্রোত

ভাসিয়ে দিচ্ছে আমার সংগৃহীত মূল্যবোধ।


শূন্যে পাক খেতে খেতে

মঞ্চের দিকে চলে যাচ্ছি 

মঞ্চে মঞ্চে অদ্ভুত নাটক


কিছু কি হারাচ্ছি আমি ?

আমার পোশাক কেড়ে নিয়ো না শহর

সম্ভ্রমটুকু থাক

নিজেকে নিজের মতো দেখি

আমার ভিতরে আমি গ্রামকে বাঁচাই !


  ৯.

 নির্ঘুম পাথর


এখানে তেমন জায়গা নেই ,দাঁড়ানো যাবে না

তবু কেন ঘুমোবার সাধ জেগে উঠে ?

স্বপ্ন আসতে চাইছে বলে

মনে মনে নিত্য আয়োজন


কোলাহলের প্রাচুর্যের ভেতর থেকে 

নিজেকে টেনে নিয়ে এখানে এসেছি

এখানেও ব্যাভিচার পড়ে আছে

মৃত স্বপ্নের ভ্রূণ, ভ্রূণের হাহাকার

হৃদয়ের নিরীহ অশ্রুপাতে ভেজা মাটি


এখানে কি সুস্থতা থাকে ?

সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যাওয়া

শূন্যতায় ঘুরপাক খেতে খেতে 

পাথর হয়ে যেতে থাকি 

নির্ঘুম পাথর এক


           ১০.

করুণ সংকল্পটি


বেশ নাচ্ নাচ্ মনে হচ্ছে পৃথিবীকে 

এত ঢেউ উঠছে, হাসির ফোয়ারা ছড়াচ্ছে 

আর কলকাকলির জোয়ার আনছে 

সকাল থেকেই উৎসবের মেজাজ 

আমার মৃতদেহ কোথায় রেখে যাব তবে? 


শকুনেরা মাংস ছোঁবে না, 

কীট পতঙ্গেরা ঘৃণা করবে 

আমার চেতনারাও কি তবে 

জল প্রবাহে মিশে যাবে না? 

এই মাটিতে শুয়ে শুয়ে রোজ  

বৃষ্টিকে ডাকি 

মেঘ আর বাতাসের বৈভবে 

নিজেকে সঁপে দিই 

তবু আনন্দযজ্ঞে আমার এই 

                  আহুতি ভয় 


কবি পরিচিতি : জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে। 

পিতা ও মাতা :জিকির খান ও নাওরাতুন। 

পড়াশোনা :বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি প্রাপ্তি। 

পেশা : উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক । 

প্রকাশিত কাব্য : কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) ইত্যাদি। 

পুরস্কার : কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার ও দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, কবি আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার ইত্যাদি ।

ঠিকানা : রামরামপুর (শান্তিপাড়া), রামপুরহাট, বীরভূম, পিন ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।




















          





No comments:

Post a Comment

গুচ্ছ কবিতা।।তৈমুর খান ।।

সমস্ত যুদ্ধের পর   অনেক মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকা  হেসে ওঠে মাঝরাতে  কোনও পিয়ানোর সুরে  খোলাচুল উড়ে আসে তার  বুকের ভেতর থেকে জ্যোৎস্নার ফণা ...