August 29, 2021

কবিতায় চিরদিনের হওয়া নিয়ে কিছু কথা।। আবদুস সালাম

 কবিতায় চিরদিনের হওয়া নিয়ে কিছু কথা


সকলেই যেমনি কবিতা লেখেন না তেমনি সকলে কবিতা ও পড়েনও না। যারা পড়েন তাদের অনেকেই একটি কবিতার আবেগ, অভিজ্ঞতা ,অনুভব কিভাবে ধরা পড়েছে, পাঠকের মনে কিভাবে তখন পুনঃসৃষ্ট হচ্ছে সেসব বিচার বিশ্লেষণের প্রয়োজন বোধ করেন না ।তাছাড়া এই সূক্ষ্ম বিচার বিশ্লেষণের জন্য কবিতা পাঠের যে নিবিড় অনুশীলন ,রুচি ও রসবোধের পরিশীলন দরকার অনেক পাঠকের তেমনটি থাকে না।


     ভালো কবিতা লেখা যেমন সহজ নয় তেমনই সহজ নয় একটি কবিতাকে ভালোভাবে বোঝা এবং মূল্যায়ন করা। ভালো কবিতা লেখা হলে তার আবেদন যুগকে অতিক্রম করে।এলিয়ট বলেছেন "Genuine poetry can communicate before it is under stood"


     তবু ও কবিতার সামগ্রিক মূল্যায়নকে অস্বীকার করা যায় না। যদিও কবিতা ভাব দিয়ে লেখা হয়না, শব্দ দিয়ে লেখা হয়।

  একটা সার্থক কবিতায় কবির ভাবনা মিশে যায় অনন্ত কালে।

  " কবিতা একধরনের হৃদয় চর্চা।হৃদয়ের কাছেই কবিতার আবেদন একথা পুরোনো হলে ও আজ তা সত্য । পৃথিবী জুড়ে যদি মানুষের হৃদয় না থাকে অর্থাৎ সব হৃদয়ের মৃত্যু ঘটে তবে কবিতারই বা ভবিষ্যৎ থাকবে কেন? কবিতা কার কাছে বাঁচার আবেদন করবে?" -----তৈমুর খান


জীবনানন্দ বহু আগেই একটি কবিতা তে হৃদয়ের কথায় বলতে চেয়েছিলেন-----

   "যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি

 এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয় মহৎ সত্য বা রীতি,

 কিংবা শিল্প অথবা সাধনা শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয় "---জীবনানন্দ দাশ


    কবিতা লিখে অমরত্ব চেয়েছিলেন' মাইকেল-মধুসূদন-দত্ত 

তিনি বলেছিলেন" রেখো মা দাসেরে মন

 এ মিনতি করি পদে-"-- 


আমরা কি কবিতা লিখে অমরত্ব লাভ করতে পারব ? কবিতা লিখে যশস্বী হতে পারব ?

    কবিগুরুকে শতবর্ষ পরেও স্মরণ করে চলেছি।  

 প্রতিদিনের কষ্টকর মুহূর্তগুলো ,গ্লানিগুলো, অসহায় হাহাকার গুলো গুঁজে দিচ্ছি কবিতার শরীরে । আমরা যেসব কবিতা লিখি সেসব কবিতা কি আদৌ কালের ধোপে টিকে থাকতে পারবে ? আমাদের বেঁচে থাকা, দিনযাপনের ক্ষণে বিচ্ছিন্ন মুহূর্ত গুলো ঝরা পাতার মতো ছুটে বেড়ায় । আমরা তাদের ধরে এনে কবিতার পঙক্তিতে বসানোর চেষ্টা করি। এতে আমাদের বোধের যতো উত্তরণ ঘটে তাতে কিন্তু ভবিষ্যৎ ভাবনা থাকে না। প্রতিক্ষণে আমাদের প্রেম ছিন্ন হয় ,বেকারত্বের জ্বালা আমাদের কে কুরে কুরে খায়। কাজ হারানোর দায় কাঁধে চেপে পড়ে ।রাজনৈতিক টানাপোড়েনে আমরা বিধ্বস্ত হই বারবার ।আমাদের স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। প্রতিনিয়ত পৃথিবীর হিসেব-নিকেশে আমরা ডুবে থাকি । 


     অপার্থিব্য চেতনা আমাদের আকৃষ্ট করে না । তবু সবাই কবিতা লিখে চলেছে, লিখে চলেছি। এই প্রজন্মের ভূগোলে উঠে আসছে নতুন নতুন কবিমুখ ।কবিতা তারা লিখে চলেছে তাদের অভিমান , তাদের বিদ্রোহ, তাদের জটিল জীবনের অন্বয় ।ক্লান্তিকর জীবনের ছায়ায় বেড়ে উঠছে তাদের কবিতা ।যন্ত্রণাবিদ্ধ হচ্ছে সময়। সময়ের মর্মে মর্মে গেঁথে দিচ্ছে আবেগের স্বর । 


     আমরা দিন দিন হয়ে চলেছি নকল বাজ। অন্যের যাপন চিত্র নকল করে চলেছি অবলীলায় ।গভীর রাতে যন্ত্রণার সমুদ্রে ডুব দিয়ে নিজেকে খুন করে চলেছি নিয়ত । এ সময় আমরা যে মানুষ সে কথা ভুলতেও বসেছি । এতে আমাদের কোনো বিকার নেই , অনুতাপ নেই ।গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলেছি । অধুনা সভ্যতায় ঘটে চলেছে মনুষ্য দূষণ,মনন দূষণ, পরিবেশ দূষণ। নাগরিক সভ্যতায় গড়ে উঠেছে শুঁড়িখানা ,বেশ্যাখানা । তৈরী হচ্ছে বেশ্যানগর, তৈরী হচ্ছে বেশ্যা সভ্যতা । ভালোবাসা দিন দিন পরিণত হচ্ছে রেশমকীটে । তৈরি হচ্ছে বৃদ্ধাশ্রম। বাস্তবের দোহায় দিয়ে ক্লান্তিকর জীবনের ছায়ায় বেড়ে উঠছে কবিতার গাছ । কবিতা। হয়ে চলেছে দিন দিন যন্ত্রণালব্ধ মরমী শব্দের সমাহার।

    শিল্প সাহিত্য নিয়ে একটা প্রবাদ লক্ষ্য করি "সমাজে যাহা ঘটে চলেছে তাহায় সাহিত্য"--- অবশ্যই এটা সত্য কথন । কেননা সাহিত্য তে সমাজের দর্পণ। তবে প্রাচীন কাল থেকে অদ্যাবধি বাস্তববাদী সচেতন শিল্পী, সাহিত্যিকবৃন্দ বলেছেন অন্যকথা। তারা সর্বদায় বলেছেন সাহিত্যের কাজ কেবল মাত্র সমাজের দর্পণ হওয়া নয় , তাদের দায় অনেক বেশি বৃহত্তর । একজন সমাজ সচেতন শিল্পীর কর্তব্য -সমাজে যা ঘটে তা শুধু প্রকাশ করা নয়, সমাজে যাকিছু ঘটা উচিত ছিল তার সম্ভাব্য রূপ কে রূপায়িত করা ।  


   এখন প্রশ্ন কবিতা কি আমাদের এই সকল শর্ত পূরণ করতে সক্ষম? কবিতা সকলের পাঠ্য তালিকায় জায়গা করে নিতে সক্ষম?কবিতা কি সকলে পড়ে ? কবিতা নিয়ে আমাদের যে এতো ভাবনা তাকে পাঠক কতটা সমাদর করছে--প্রশ্ন থেকেই যায়। তা নিয়ে আমাদের ভাবনার বিষয় না হলে ও এর ভাবনা থেকে আমরা সরে আসতে পারিনা। 


   তবুও কবিতা লেখা হচ্ছে প্রতিদিন। জন্ম হচ্ছে অজস্র কবিতা । প্রতিদিনের কবিতায় আমরা লিখে যাচ্ছি আমাদের অভিমান, আমাদের বিদ্রোহ, আমাদের জটিলতা, আমাদের প্রেম আমাদের সংসার যাপন । ক্লান্তিহীন ঝড়ের বিপন্ন ছায়ায় কবিতা জিরিয়ে নিচ্ছে প্রতিদিন । ক্লান্ত বিপন্ন জীবনের কথা কি আগামী সভ্যতার প্রজন্মের কাছে উত্তরণের পথ দেখাবে?


             জীবনযন্ত্রণায় হতাশার অন্ধকারে আচ্ছন্ন আমাদের জীবন। আমাদের প্রতিনিয়ত চলাফেরা, আমাদের প্রতিনিয়ত যাপন, আমাদের জীবনের অসহায় মুহূর্তগুলোকে গ্রাস করে চলেছে ।সেখানে একাকীত্ব , হাহাকার ,হতাশা ,করুণ অসহায়গুলো আমাদের জীবনকে নিরাপত্তাহীনতায় ভরিয়ে তুলেছে। তাই সমসাময়িক কালের পরিপ্রেক্ষিতে জটিল জীবনযাপন সম্পর্কে টানাপোড়েন ,বিশ্বাসহীনতা, রাজনৈতিক খুনোখুনি থেকে আমরা কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছি না । তবুও কবিতা লেখা হচ্ছে প্রতিদিন।


 কবি কবিতায় লিখে চলেছেন প্রেম অথবা প্রেমহীনতা, প্রকৃতির রূপ ,বৈচিত্র, মানব মনের নানা জটিলতা, সমাজজীবনের কীর্তি, বিপর্যয়, আবেগ অনুভূতি ও মননের সংশ্লিষ্ট আরো কত নানান বিষয় কবিতার শরীরে সেঁটে দেওয়া হচ্ছে। শব্দের, চিত্রকল্পের অভিনবত্ব, আঙ্গিক আর কৌশলের ভিতর যেতে হয় কবিদের। ব্যক্তি বিশেষের তাৎক্ষণিক আবেগ ও অনুভূত হয় কবিতার শরীরে।


     নানা আঙ্গিকে পাঠকের কাছে পৌঁছাতে হয় কবি কে ।কবিতার তাৎপর্য নিছক বুদ্ধিচর্চায় আবদ্ধ থাকলে চলে না। ব্যক্তিগত আবেগ অভিজ্ঞতা কবিতার শরীরে সেঁটে দিতে হয় । পার্লারে গিয়ে যেমন কুৎসিৎ বউ কে সুন্দরী সাজিয়ে আসরে বসানো হয় তেমনি কবিতা কেও সেই ভাবে অলংকার দিয়ে কবিতা যোগ্য করার প্রয়াস চালানো হয় ।আবেগ জা্রিত মনন, মননের উদবর্তন ও উদ্ভাসনই কবিতার উত্তরণ ঘটায় । নৈর্ব্যক্তিকতা কবিতার মূল্যায়ন স্থায়িত্ব করে ।কবির ব্যক্তিগত ভাবনা ,বিশুদ্ধ চিন্তা ইত্যাদিকে কৃত্রিম বৈধতা দেবার চেষ্টা করেন ।আবেগ-অনুভূতি মনন , প্রভৃতি শাব্দিক উদ্ভাসন একজন পাঠক সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন। শব্দের নির্মাণ , শব্দের চেতন গত বৈশিষ্ট্য, চেতনার নীবিড় সমবায়ে রচিত হয় কবিতা।


 শব্দ দিয়ে যখন কবিতা তৈরি হয় তখন আমরা দেখি একজন প্রতিভাবান কবি পুরনো শব্দ কে ঘষেমেজে নতুন শব্দ তৈরি করেন , চেষ্টা করেন নতুন রূপ দিতে ।সুর ও চেতনার সঙ্গে সার্থক সমন্বয়ে স্মৃতিময় শব্দ বিন্যাসে উদ্ভাসিত হয় কবিতার অন্তঃসত্ত্বা ।শব্দ নির্বাচনের সচেতনতা কবিকে অমরত্ব দান করে । কবিতা সম্পর্কে কেউ বলেছেন প্রথম শ্রেণির কবির প্রাথমিক কাজ মৃত শব্দকে সঞ্জীবিত করা, আর পুরনো অচল শব্দ বর্জন করে নতুন নতুন শব্দ তৈরি করা। ভাষা ও ছন্দকে প্রাণবন্ত করা ।সংস্কৃতির সজীবতার লক্ষণ হলো প্রাণবন্ত শব্দ ভাষা প্রয়োগ করা ।শুধু অক্ষরের বিন্যাস চেতনার ধারক বাহক ও বটে ।কবিতার শরীরে নতুন শব্দ যেমন চমক আনে তেমনি পাঠক সমাজকেও কবিতার শরীরে ডুবে যেতে আমন্ত্রণ জানাই।


ভাষা বৈশিষ্ট্য কবিকে অমরত্ব দান করে। জীবনানন্দের কবিতায় দেখি সেই সব অনবদ্য চিত্র কথা , শব্দ বৈচিত্র।


"চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা--"-

"পাখির নীড়ের মতো চোখ"

"শকুন শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়---"

জীবনানন্দ দাশ


"তাই দুটো পায়ের মধ্যেকার দূরত্ব দেখে বোঝা যায়

সে আজ কতো ভোরে উঠেছে--"-

ঋত্বিক ত্রিপাঠী


" কুমারী নক্ষত্রের পবিত্রতা----

ধূসর শূন্যতার পথে বানিজ্যে চলেছে বণিকেরা---

ভোরের ক্লান্তির কাছে মনে পড়ে শূন্যতা---

প্রকৃতির ছদ্মবেশ খুলে যাবে লৌকিক কথনে---

নির্বিকার পৃথিবী প্রতিদিন থলে হাতে বাজারে গিয়েছে---" নাসিম এ আলম

নৌকার চেয়ে ও ছোট হয়ে এসেছে নদী---

আমি তার কিনারায় বসে বাজনা বাজায় আর চাপা দিই মানুষের কান্না---

সঙ্গীতের পোড়া গন্ধের মত সূর্য---

ঢেউয়ের মধ্যে সমুদ্র মূর্ছা গেল---

পুবে পারদের নীচে ডুবে যাচ্ছে আকাশ---

ধীরে বয়ে যাচ্ছে সময়

মেঘের মধ্যে দোকানের অনুভূতি

নিরবতায় বেঁচে রয়েছে মানুষের মনে গোঙানি তারা এখন ও হেঁটে বেড়াচ্ছে স্যাঁতস্যেঁতে বুদ্ধিতে---

  গোলাম রসুল


গাছেরা রাতের ছাদে সর্বনাশের গান করে--- 

মরীচিকা প্রেম সনির্বন্ধ ক্রিয়াশীল হলে রাত নেমে আসে শরীরের হাটে---

 ভেসে যায় সভ্যতা

 সুন্দরীরা শুকায় চুল ----

মানবিক মুখ সেলাই করে চেনা চেনা দুঃখ---

 উঠোন জুড়ে জাতীয় সড়কের ক্ষতচিহ্ন----

 ঘরে ঘরে দুঃখের উনুন----

 বিবর্তনের গা ঘেঁষে পুড়ে যায় শ্বাসকষ্ট---

অসফল ধূসর স্বপ্নেরা চৈত্রের ঝড়ে ঠুংরি গায়---

  পূর্ব পুরুষেরা ইতিহাসের মলিন পৃষ্ঠায় এঁকে রেখেছে রক্তের জলছবি---

 মরা নদীর পাশ দিয়ে হেটে যায় অবিশ্বাস---

আবদুস সালাম


টুকরো টুকরো ছায়ায় আমাদের নষ্ট বিশ্রাম 

অপেক্ষায় আছে----

 আমাদের ছেঁড়া বর্ণপরিচয় প্রতিটি সকাল চেনে----

 তোমার কুয়ো থেকে তুলে নিচ্ছি দুঃখ----

 মুরগি জন্মের পর সভ্যতায় কোন সকালে আসবে?----

 শহীদের রক্তের আলপনায় তৈরি হয় ইতিহাসের নকশা---

 ক্রমশ বার্ধক্য আসে

দোকান গুলো সব বন্ধ হয়ে যায় একে একে---

 নিজেদের ম্লান ছায়ার ধারে অন্ধকার এঁকে রাখি--- 

আত্মঘাতী তীব্র নীরবতা ----

গলায় কলসি অথবা বালতির হুঁকে

 যৌবনের নীল মেঘ ভেসে ভেসে আসে----

 একটি বিপন্ন ঘোড়া

 পিঠে সংসার চেপে আছ

 দীর্ঘশ্বাস ফেলছে সদস্যরা----

তৈমুর খান


এমন সব বাক্য বন্ধ কবি কে চিনতে সাহায্য করে। শিল্প সাহিত্যের স্রষ্টাগণ নতুন নতুন ভান্ডার উজাড় করে দিচ্ছেন পাঠকের দরবারে । চিরদিন এই শব্দের খেলায় মেতে চলেছেন কবি কূল।যে সকল কবি সাহিত্যিকবৃন্দ নিজেদের নতুন করে তুলতে সমর্থ হয়েছেন, যুগের পারে অন্য যুগে জমিয়েছেন পাড়ি। তাদের কে আমরা মনে রেখেছি ‌। যুগের কষ্টিপাথরে তারা উত্তীর্ণ। মানবিক প্রাণ দেওয়া-নেওয়া , জীবনে জীবনের যোগ করে বাঁচিয়ে রাখে স্বপ্নকে ।স্বপ্নের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বর্তমান সময়ে এই একান্ত অনুভব এর মুহূর্ত উপহার দেন । আবেগ বা হৃদয়ের স্পন্দন আমাদের কমে আসছে । মানবিক পৃথিবীর মরে মরে যাচ্ছে ক্রমশ ।জীবন গঠনের প্রক্রিয়ায় যে অনুভব , সামাজিক দূরত্বে অবস্থান করে তার সনির্বন্ধ নির্যাস কবিতায় তুলে ধরার প্রয়াস লক্ষ্য করি ।ছোট ছোট কাব্যরসে প্লাবিত হয় কাব্যের মাঠ । আগামী দিনগুলোর সম্ভাব্য মরমী কথা তুলে ধরেন কবিতায় । আগামী প্রজন্ম খুঁজে পায় তাদের আত্মার কথা । মনে হয় হয় এ কবিতা এখন ই লেখা হয়েছে । এর আবেদন চিরকালের । আর তখনই কবিতা কাল জয়ী হয়ে অনন্ত কাল বিরাজ করে । যতদিন তার প্রবৃত্তি থাকে , আবেদন থাকে ,অন্যকে কাছে ডাকার আকুতি থাকে ততদিন সেই কবিতায় দৌড় থাকে । আর এটাই হলো কালজয়ী , চিরন্তনী । তখন কবিতা লালিত হয় ,ডানা মেলে ওড়ে । মানুষ স্বপ্নের ভাষা খুঁজে পাই । 


      আবেগের কাছে আমরা সকলেই দায়বদ্ধ। আত্ম সর্বস্ব জীবনে আমরা বন্দি হয়ে নিজের সুখ উপভোগ ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারিনা ।তখন এই সকল মরমী কবিতার আবেদন ভবিষ্যতেও সঞ্চালিত হতে থাকে । এখানেই কবিতার অমরত্ব। আত্মগত জীবনের ভিতরে যখন কবিরা নিজেদের গুটিয়ে নেন ,পৃথিবীর মানুষ তখন মানুষ- কসাই সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় ।আমরা চিনতে পারিনা কে খুনি কে সাধু ।মুখোশের আড়ালে আত্মিক জগতে তারা বন্দী হয়ে যায়। যন্ত্রনির্ভর সভ্যতায় মানুষ ক্রমশ হয়ে উঠেছে যন্ত্রনির্ভর । মানব জীবনে যত বিলাসিতা , যত অশ্লীল আনন্দে নিজেকে মাতিয়ে তুলছে ততই মানুষ আহ্বান করছে মৃত্যু কে । কবিতা শুধু বেঁচে থাকে হৃদয়ে ।আর হৃদয় যদি না থাকে তবে কোথায় থাকবে ? কবিতার সমালোচনা ধোপে অবশ্যই মহান কবিদের কৃতিত্ব কে ম্লান করা যায়নি ।তাদের কবিতায় বিশ্বের মানুষ বারবার সামাজিক ও নৈতিক ভাবে সমৃদ্ধ হয়ে সৃষ্টিশীল হয়ে পথের নির্দেশ দিয়েছে । এখানেই কবিতার সার্থকতা। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ খুঁজে পাই নজরুল ইসলামের কবিতায়।


  মানব সভ্যতার বিভিন্ন যুগে সমাজ সচেতন ও সংবেদনশীল শিল্পী-সাহিত্যিকরা শিখিয়েছেন মহান কর্মকাণ্ড ও সমাজব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। মানুষের মনের অন্ধকারকে দূর করে দিতে প্রেরণা যোগায়। তাকে সামাজিক কর্তব্য পরায়ন করে তুলতে সাহায্য করে । এগুলো প্রকাশ করা , জন সমক্ষে আনা এবং নতুন প্রজন্মের কাছে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া শিল্প-সাহিত্যের স্বাধীন কাজ ও কর্তব্য ।অবশ্য অতি বাস্তববাদী surrealist বাmetaphysical শিল্পী মহলে এ কথা মানে না ।তবে তারা এমন কিছু প্রকাশ বা সৃষ্টি করতে চান যা সামাজিক প্রগতিকে ব্যাহত করে, এটাই নাকি এদের কাছে শিল্পের স্বাধীনতা ।এদের কাছে মানুষের যথার্থ পরিচয় মানে তার পেটুকতা ,লালসা ,যৌনাচার ইত্যাদি শারীরবৃত্তীয় পরিচয় । রবীন্দ্রনাথ এদের সম্পর্কে বলেছেন "এরা দুর্বল দেশে মাঝে মাঝে রাজ সিংহাসন হরণ করে নেয়, কিন্তু মানব ইতিহাসে কোথাও কোনো স্থায়ী গৌরব লাভ করতে পারেনি"।কদর্য বাস্তব বর্জিত, শারীরবৃত্তীয় চটুল কবিরা হয়তো সাময়িক ভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে কিন্তু কালের গতি তাকে ভাসিয়ে দিবে অথৈ সাগরে।


   মাইকেল মধুসূদনওরবীন্দ্র পরবর্তী বহু কবি এসেছেন গীতিকবিতার প্রবাহমান ধারা কে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করে, রূপবতী-লাবণ্যময়ী করে তুলতে । আমরা কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ,বিষ্ঞু দে ,অমিয় চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ,জয় গোস্বামী, ইদানীং একদম হাল আমলের কয়েক জন কবি অলোক রঞ্জন দাস গুপ্ত, কাওসার জামাল, মন্দাক্রান্তা সেন, তৈমুর খান, গোলাম রশুল এর কবিতা পড়ছি । কবিতার মানচিত্র অনেক বড়ো হচ্ছে এতে কোন সন্দেহই নেই। তবে কালের প্রবাহে কতো জনের কবিতা কালজয়ী হবে তার সময় বলবে । সমাজের প্রয়োজন বাস্তবসম্মত , সচেতন যুক্তিগ্রাহ্য শিল্প সাহিত্য।যার দ্বারা আগামী মানুষ খুঁজে পাবে আশার আলো, খুঁজে পাবে সুন্দর সমাজ গড়ার প্রেরণা। গড়ে উঠবে সুস্থ সংস্কৃতি। আমরা কবিতা কে কালের নৌকায় চাপিয়ে দিলাম।

1 comment:

  1. মহুয়ার দেশ এর সকল সভ্যবৃন্দকে হার্দিক শুভেচ্ছা। একটা অনবদ্য সংখ্যা উপহার দেওয়ার জন্য।

    ReplyDelete

গুচ্ছ কবিতা।।তৈমুর খান ।।

সমস্ত যুদ্ধের পর   অনেক মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকা  হেসে ওঠে মাঝরাতে  কোনও পিয়ানোর সুরে  খোলাচুল উড়ে আসে তার  বুকের ভেতর থেকে জ্যোৎস্নার ফণা ...