গুচ্ছ কবিতা
১.
যুগের প্রচ্ছদ
অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছি
পিতার আকাশে অনেক নক্ষত্র ঝরে গেলে
অন্ধকারের ছায়ায় ব্যক্তিত্ব উঁকি মারে
কেমন করে ডাকব নিজেকে ?
সামনাসামনি নীরব ও আমি
চেয়ে আছি সুদূর চৈতন্য পারে
আজ কোনো গল্প নেই
গল্পরা চরতে গেছে মাঠের অন্ধকারে
এক একটি বাইরের তরঙ্গ
নোনতা ফাগুনের সংবাদে
আমাকে ভেজাতে আসে —
দীর্ঘ ফণায় তাদের সম্মোহন কাঁপে
দরজা খুলি । সমস্ত ক্ষয়ের চিহ্নগুলি
যুগের প্রচ্ছদ ।
অস্তিত্ব নেই । শব্দের দেয়ালে
সময়ের নিরর্থ নির্দেশ ।
২
ভোর
মৃত্যুর কলোনিতে ভোর এল
জেগে উঠছে মৃতেরা এবার
রোদ্দুরেরা শাড়ি মেলছে
কাকলিরা বসাচ্ছে বাজার
নাচের স্কুল খুলে দিয়েছে হাওয়া
পাতাদের কানাকানি
ভ্রমরদের শুরু আসা-যাওয়া
৩
যার জন্য
কার কণ্ঠস্বর ?
ভ্রমের তুলনা ভেঙে ভেঙে
সত্যেরও অপলাপ হয়
দীর্ঘ ছায়ার গাছে
যদিও অনবদ্য কুসুম ফোটে
কুসুম কি জানে সুখ ?
যার জন্য সমস্ত বিকেল গেল
যার জন্য স্বপ্নেরা শুকনো কিংশুক
৪
শ্রীনিরপেক্ষ
চারিপাশে নীল মাছ
বুড়বুড়ি তুলছে
আমি কেন তাদের মতো হব ?
চারিপাশে মাছধরা লোক
টোপ ফেলে বসে আছে
আমি কেন সবার মতন টোপ খাব?
জলে অন্তর্বাহী স্রোত
বিষণ্ণ শ্যাওলার কাছে
আমি নিরপেক্ষ হতে চাই
যদিও এখানে বেশিক্ষণ স্থায়ী হওয়া যাবে না কখনও
৫
বাসা বদল
বাসা বদল করার কথা হচ্ছে ঘন ঘন
এবার কোন্ বনে যেতে হবে…
সবকিছু বুঝে তারপর
জীবনের ইতিবৃত্ত অলিখিত রেখে
একটা শ্লেট শুধু
সাদা পেন্সিলে ভর্তি করতে চাই
বাসা বদল হলেও হৃদয় বদল হবে নাকো
৬
অনুভূতি
তোমার হাতের ছোঁয়াটুকু
লেগে আছে শরীরে আমার
আমি তাকে অনুভূতির অ্যালবামে রাখি
প্রতিটি বসন্তে পাতা ঝরে গেলে
তাতেই ফোটাতে চাই নতুন মঞ্জরী
অনুভূতির মৃত্যু নেই
প্রাচীনত্ব নেই
অনুভূতি রোজই এসে দরজায় দাঁড়ায়
নতুন কিশোরী
৭
আমাকে বৃষ্টির ভেতর রাখো
আমাকে বৃষ্টির ভেতর রাখো
সময়ের কোলাহলে হুলস্থুল পাড়া
আগুন জ্বালায় কারা ?
তির-ধনুক ছুটে আসে
মঞ্চে মঞ্চে যুদ্ধের মহড়া
দিন যায় । মাইকে ঘোষণা হয়
নাম পরিচয়
সামনে আলোর বৃক্ষ
মনীষীদের নাম লেখা পাতায় পাতায়
এক একটি নামের কাছে এসে
খুঁজতে থাকি কোথায় করুণা
হৃদয় কোথায় থাকে
হাত বাড়ালেই হাত কাছে আসে কিনা
আমাকে বৃষ্টির ভেতর রাখো
বিশ্বাসও অসহ্য এখন
মরে গেছে সব সান্ত্বনা !
৮
ধ্বংস বেশ বাজনা বাজাচ্ছে
মৃত মানুষের ভিড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে
সদ্য রক্তপাত আর যন্ত্রণার চিৎকার
কোন্ দিকে যাব ?
ধ্বংস বেশ বাজনা বাজাচ্ছে
সাম্রাজ্যের ইতিহাসে অন্ধকার
কোথাও যাওয়ার নেই
চকচকে কাদের উলুধ্বনি ?
অস্ত্রের বিবাহ অস্ত্রের সাথে
ধর্ষক দাঁড়িয়ে আছে ঈশ্বরের মতো
ধর্ষকের পায়ে কারা ফুল রাখে ?
কোথাও রাস্তা নেই
সভ্যতা কাঁপে এক বিস্ময়ের জ্বরে....
৯
বিষাদের দেশে
বিষাদের দেশে সন্ধ্যা এল
ভাঙা তোরঙ্গগুলি থেকে
আমাদের নিঃশেষ মূলধন
অবলুপ্ত হবে।
সাংসারিক ক্রিয়ার আলো
গৃহে গৃহে জ্বলে
গৃহিণীরা হৃদয় আগলে রাখে ।
বস্তু পৃথিবীর চাঁদ উদিত হলে
কী নামে তাকে ডাকা হবে ?
ভাঙা তোরঙ্গগুলি নিঃস্ব ইতিহাস...
১০
কলসি
পর্দা সরিয়ে নিলেই দেখি ছায়ার বাঁশি বাজে
দু একটা জোনাক ওড়ে, আগুনের দানা দানা
রূপকথাগুলি ওড়ে
সহিষ্ণু পাথর হয়ে বসে থাকে কাঙাল স্বপ্নেরা
তবু রথ চলে, ৠতুমতী নারীর কঙ্কণ বেজে ওঠে
ফিরে দেখি একাকী দাঁড়িয়ে আছি ঘাটে
কলসি একা ভেসে গেছে দূর
ও পাড়ার নতুন তরঙ্গের কাছে
১১
মরীচিকা
মরুর পাহাড়ে প্রথম সঙ্গমদৃশ্য লেখা হলো
অভাবী ঘরের চাঁদ নরম স্তনের মতো
দূর থেকে ছুঁয়ে দেখা
দু একটা হরিণ শুধু ছুটে যায়
বাঁকা ও কাতর শিঙ্ তুলে
ব্যথাতুর ঝরনার খোঁজে….
নিজেকে সামলে নিই
এইসব দৃশ্য বড় আবেগ মেশানো
রোদের ভাষায় লেখা অলীক নাটক
যদিও বাস্তব কিছু দৌড় সারাদিন
শোনায় পদধ্বনি…
১২
শিকারি
শাদা বক হয়ে দিন বসে থাকে জলে
জলের ভেতরে জটিল মাছের গান শোনে
দু একটা স্বরলিপি তুলে নেয় ঠোঁটে
কেননা, তারও জীবিকা আছে সময়ের স্রোতে
রক্তমাখা উল্লাস আর জৈব তাড়না
মাঝে মাঝে উন্মনা করে দ্যায় তাকে
জল তবু দেহ ঢেকে চলে যায় জলে
শিকারির ধ্যান বাড়ে সকালের প্রত্যাশায়
কবি পরিচিতি : জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে।
পিতা ও মাতা :জিকির খান ও নাওরাতুন।
পড়াশোনা :বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি প্রাপ্তি।
পেশা : উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক ।
প্রকাশিত কাব্য : কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) ইত্যাদি।
পুরস্কার : কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার ও দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, কবি আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার ইত্যাদি ।
ঠিকানা : রামরামপুর (শান্তিপাড়া), রামপুরহাট, বীরভূম, পিন ৭৩১২২৪, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।