November 29, 2020

সম্পাদকীয়

এই বছর বিষময়।মৃত্যু মিছিলের শেষ নেই।বাঙালি মেধা ও মননের নক্ষত্রপুঞ্জ থেকে একটি একটি করে তারা খসে পড়ছে। বাঙালির গর্ব করার মানুষ কমে আসছে।প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়,শম্ভু রক্ষিত, দেবেশ রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত সকলেই  অমৃতলোক নিবাসী।মহাকাল সময়ের সঙ্গে মানব জাতির সংঘাত নতুন নয়।শেক্সপিয়ারের সনেটগুলির ব্যপ্তি তো এই অন্তর্ঘাতে,কবি কালো অক্ষরে নিজেকে অমর করে গেছেন।ঘাতক মহাকাল সেই দ্রতগামী বলীয়ান রথে চড়ে যতোই অগ্রসর হোক না কেন মহামানব তাঁর সৃজনশীল কর্মের
মধ্য দিয়েই বিজয় লাভ করেন। 

একজন কবি কোনো পত্রিকায় কবিতা দিয়ে আশা করেন তাঁর কবিতা পাঠক পড়ুক।পড়ার পর পাঠকের মনে কিছু বিস্ময় বোধ,ভালো লাগা থাকুক।কবি ও পাঠক মানসের সেতু স্বরূপ মহুয়ার দেশ কাজ করবে আশা রাখি। 

আজ "মহুয়ার দেশ" আলো সংখ্যা প্রকাশিত হল।প্রচ্ছদ চিত্রটি তুলেছেন শ্রেষ্ঠা চ্যাটার্জী।শুধু ভালোবাসার মূল্যে ছবিটি ব্যবহার করতে দিয়েছেন।

অভিষেক সৎপথী
সম্পাদক, 
মহুয়ার দেশ





গোলাম রসুল

ওরা কিভাবে গিয়েছিল জানি না


চিরদিনের জন্য ওরা চলে গেল

ওরা কিভাবে গিয়েছিল জানি না
সবচেয়ে প্রাচীন একটি মৃত্যুর মতো

তখনো ওদের বিছানা গুলো পাহারা দিচ্ছিলাম
এবং কয়েকটি নক্ষত্রের সঙ্গে আমরা স্বপ্নের দিকে যাচ্ছিলাম
উড়তে উড়তে পাখিদের জনতা বরফে ঢাকা পড়েছে যেদিকে

আমাদের বাড়িগুলো মেঘের থেকেও পুরোনো
খসে পড়ছে কিছু কিছু অংশ
আর চোখ বন্ধ করে নেওয়া সমুদ্রের ওপর তারা দাঁড়িয়ে

বুজে যাওয়া গর্ত থেকে উঠে আসছে আরো কিছু মূর্তি
তারাও আমাদের মতো সাঁতার কাটতে জানে না

ভোর হলো
ডিমের খোলা কাগজের ওপরে সূর্য এঁকে যাচ্ছে আরেকটি দিন

পাখনায় ওড়া আকাশ
পৃথিবীর সংকেত
আলাদা দেয়  আমাদের জীবন




সব্যসাচী পন্ডা

অপাপ

ঘৃণা লিখিনা আর...
লিখিনা অক্ষরে অভিশাপ।
বিষাদ লিখি না আর...
লিখিনা হৃদয়ের সংহার।
ব্যথার আবহটুকু  করিনা রচনা আর...
লিখিনা কষ্ট... যাতনা পদ্য।

হে প্রেম,তোমারই অমলিন কিরনে
আমি অপাপ বিদ্ধ



উমা মাহাতো

।। জংলী।। 

।।এক।।

আলো না অন্ধকার বুঝি না।কিন্তু সে আমিই ছিলাম।বহু শতাব্দীর সাধনায় গাছেদের  পারস্পরিক কাছে আসা।দীপ্যমান আগুনে জ্বলে ওঠা।অস্ত্র হাতে ঠোকাঠুকি, চকমকি।রক্তের বিস্বাদ থেকে পালিয়ে বাঁচা--সেও তো আমি, আমারই ধর্ম  এগিয়ে চলা।

কিন্তু পোড়া শরীরের  ঘ্রাণ?মুণ্ডহীন ধড়ে কাঁচামাংসের স্বাদ আমি কি কখনো পেতে চেয়েছি আবার?লক্ষ কোটি বছর, মহুয়ার দেশে মানুষ দেখেছি  বলে বড়ো ভালোবাসি ফুল হয়ে ফুটে ওঠা!অযুত বিনম্র স্বরে বলি,আমারই ধর্ম পিছিয়ে পড়া।  

।।দুই।।  

হরিণ জানে বাঘ তাকে সুযোগ পেলেই খাবে।শত্রু পরিচিত হলে ঘনঘোর বনপথেও অপার্থিব জীবনসুষমা।মম চিত্তে নিতি নৃত্য। 

সভ্যতা গর্বী মানবজাতি  মহানগরের পথে শ্যুটআউট হয়ে যায়।মানুষ যা করে তাই অপরূপ। জংলীদের সঙ্গে তাদের তফাত বিস্তর।     




সৃজা রায়

 চন্দ্রবিন্দু...

শুকনো কাঠ পড়ে থাকলে জ্বলতে দেখাটা,
সহমর্মিতার শীর্ষ নিশ্বাস হতে পারে।
ঘুরে ফিরে অচেতন মায়াবকুল মিশে যায় শিরায়।
কেন্দ্রবিন্দুরূপে পাটাতনটি নাগালের বাইরে;
তখন কোথায় তারুণ্য কোথায় বিপ্লব!
জেরুজালেমের  কোনো অন্ধ গলি দিয়ে,
উধাও হতে চায় সুবর্ণরশ্মি।
শেষ পাতে চুরুটের নিমেষে সন্ধি হয় প্রচ্ছদে।
সমাজের পৃষ্ঠপোষকদের দেওয়াল ঘেসে,

অবিরত প্রতিশোধ, ভাড়াটে বাড়ি থেকে চন্দ্রবিন্দুর প্রতি।



সুকুমার কর

তিনটি কবিতা


লোকটা
    
মেয়েটা ভাঙনের দেশ
লোকটা স্বপ্নের বাঁধ

উথালপাতাল ঝড়
ভেসে গেছে ঘরবাড়ি

লোকটার মাথায় বাবরিচুল
লোকটা আজও বাতাসী বাতাসী
বলে শহর তোলপাড় করে

স্নেহ      

বাবা সুরক্ষার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালে
মা আমার মাথায় শুশ্রুষার হাত রাখেন
প্রিয়তমা ভালোবাসার রাজমহলে
দিন বদলের স্বপ্ন দেখি

রুক্ষ পাহাড়ের বুকে
তিরতিরে ঝরার গান
তোমরা নাম দিয়েছ স্নেহ

শিক্ষা
      
যে যায় সে যায়
কেউ ফিরে আসেনা
ভালোবাসা ঠিকানা বদলায়
আমি তোমার চৌকাঠে মাথা রেখে
শিখে নিচ্ছি চিতাকে পিছনে রেখে
কি ভাবে আগুন গিলে খেতে হয়।




বিশেষ গদ্য।সুব্রত চক্রবর্তী।

এক পৃথিবী দেখতে চেয়ে...


সদ্য শীত এসেছে। হিম নামছে সকাল সন্ধে। সকালের
আলো ফুটলে আলোর খোঁজে পথে হাঁটে পথভ্রষ্ট পথিক। 
এক পৃথিবী দেখবে বলে। হাঁটতে হাঁটতে তার দেখা হয় আততায়ী হাওয়ার সঙ্গে। হাওয়া অতর্কিতে এসে আক্রমণ শানায়। জামার ভিতর পালক বুকে এসে বিঁধে।গাছের দল কুয়াশা মেখে মূক দর্শক হয়ে বেবাক দাঁড়িয়ে থাকে।কথা কওয়া বারণ তাদের।অনিবার্য কারণে তাদের মুখ ভার। ঘাসের  উপর ভেজা শিশিরেরও মন ভারী। রুখা মাটি কেবল বৃথা চেষ্টায় প্রাণপণে মুখ লুকায় ভেজা ঘাসমূলে। শীতের সকালে এক পৃথিবী দেখবে বলে আর এক পৃথিবী পথিক রেখে এসেছি ঘরে। ফেলে আসা পৃথিবী তখনো ঘুমে, উষ্ণ ওমে। সেখানে লেপের নিচে ভাঙছে রাতজাগা খাট। নীল আলো গড়াগড়ি খায় ভোরের বিছানায়। দরজায় কড়া নাড়ে দু'কাপ কড়া কফি। বারান্দায় চায়ের কাপে ছাই হয় দামী ব্র্যান্ডের সিগারেট। আদুরে গলায় গলা জড়িয়ে নিচু স্বরে পাশ থেকে কেউ ডাকে "এই, ওঠো না! কাজের মাসি! ঘর মোছা বাকি! তোমার মা! চা ঢেলে জানলায়! উঁকি ঝুঁকি! বাবা বারান্দায়! সিগারেটের উৎকট গন্ধ!" এই পৃথিবীতে ভোর হয় দেরিতে। আলমারিতে তোলা থরে থরে আদরের বাচ্চাটির বেবিফুড। তবুও শেষ রাতে ক্ষুধায় শিশু।বিছানায় অমৃত ভাঁড় খুঁজে এপাশ ওপাশ।কোন রাই কিশোরী শীতবস্ত্র শরীরে আঁটোসাঁটো সেঁটে হারমোনিয়ামের রিডে সুর তুলে "শীতের হাওয়ায় লাগলো নাচন আমলকির ওই ডালে ডালে"।পাশে তার ধোঁয়া ওঠা কমপ্ল্যান কাপ।


হাঁটতে হাঁটতে এগোতে এগোয় পথিক। আর এক পৃথিবী ডাকছে তাকে। ভোরের আগে জেগে ওঠে সে জগৎ। সেখানে খোঁচা খোঁচা খেজুর গাছে প্রেমের রস খুঁজে প্রেমিক শিউলি। রস ফুটিয়ে ভালোবাসার জন্ম হয় শীতের ভোরে। পথের ধারে শুকনো খড়ে ধিকিধিকি জ্বলছে তাপের আগুন। হাত পা সেঁকে নিচ্ছে অথর্ব বুড়োর দল। নেংটো শিশুরা আদুল গায়ে নাচছে ধুঁয়া মেখে। সাফাই ওয়ালার বাঁশিতে হেমিলনের বাঁশি ওয়ালার সুর। বিরাম নেই কাজে ও কর্তব্যে। অলিগলি হেঁটে যায় সে প্রতিটি ভোরে। পথিক হাঁটছে। হাঁটছে কারণ এক পৃথিবী দেখবে বলে।দেয়ালের বাইরে পৃথিবী দাঁড়িয়ে আছে সূর্য সাক্ষী রেখে।কোন লেপ এই পৃথিবীর কাউকে কোনোদিন ভুলেও গলা চেপে ধরে না, নকশা করা পেয়ালাতে গরম চা অপেক্ষা করে না কোনোদিন। শুধু ডাক আসে নিরন্তর "গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গা মাটির পথ..."

 হাঁটছে পথিক সেই পৃথিবী দেখবে বলে।





সুচেতা মণ্ডল

স্নেহস্পর্শ

     

বেশ খানিকটা 
বাগান পেরিয়ে এসেছি।
বলতে গেলে সে এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পথ
খুঁজতে খুঁজতে
বাগানের পর বাগান ছাড়িয়ে অবরোহে 
পৃথিবীর আশ্রয় পেয়েছি।
মুগ্ধতার একটা স্থায়ী বাসা,
তবুও অসম্ভব ঝড়ে সব যেন উল্টে পাল্টে যাচ্ছে।
সেসব কথা থাক...

হ্যাঁ আমি স্পর্শের কথাই বলছি।
প্রতিকূল পরিবেশেও দখিনা বাতাস 
পৃথিবীর ঠোঁট ছুঁয়ে থাকে।




দীপ্তেন্দু বিকাশ ষন্নিগ্রহী

তিনটি কবিতা 

দাম্পত্য 

ডিমফুটে পাখির বাচ্চার মত চোখ মেলেছে সকাল
বিছানার খাঁজে কিছুটা রাত্রির খোঁজ 
ন্যাওটা বালিশ আজ রোদ খাবে খুব

সপ্তাহের মুখবোজা অভিযোগের ওয়াড়

অগোছালো দিনের ফাঁকতালে কখন
ঘরে ঢুকে পড়শীর আহ্লাদী বিড়াল। 

ঘুনপোকা

 ঘুন গুড়ো জমে থাকে পালঙ্কের তলায় 
একটু একটু করে এভাবেই শেষ হচ্ছে ঠাটবাট 
ঝাঁটাও ক্ষয়রোগে দিন রাত অভিশাপ দেয়
ঝেড়ে সিটি মারছে কুকার  দু টাকায় 
এখনো ঘামের গন্ধে চুয়ানো ল্যাভেন্ডার 
দাগ দাও এখনো ঝুলছে সুদিনের ক্যালেন্ডার... 

দাঁড়াও

ভোগে যাওয়ার আগে উঠে দাঁড়াও
শিরদাঁড়ায় টরেটক্কা বাজবে দ্বিধায় 
এভাবে দাঁড়াতে বলেছে কবে কেউ? 

দাঁড়িয়ে  পড়েছো যখন হাততোলো
ঝোড়ো হাওয়ায় গাছের মতো দোলাও
দূর থেকেই চিনতে পারা ফুলের মত ফোটো।

নতুবা মিশে যাও মাটিতে, ধুয়ে যাও শিশিরে
প্রত্যেক ভোরের নিজস্ব ইতিহাস আছে
চেনাজানা পথঘাট ঢেকে দিয়েছ প্রাচীরে?




শুভজিৎ মাহান্তী

নিরুপমা 

একদিন কৃষ্ণচুড়াও কেঁদেছিল 
রক্তের দিকে চেয়ে
যৌবনের খরস্রোত পেরিয়ে
অসময়ের কিউমুলোনিম্বাস
আমাকে আরো দূরে ঠেলে দিয়েছিলো
তোমার থেকে নিরুপমা।
ঘাসের শব্দ শুনে শুনে 
আমি বার বার গেছি দরজায়
অল্প বাতাসে তোমার গন্ধ পেয়েছি 

সেদিন রাতে দুজনের উষ্ণ শরীরে
রক্ত কেমন প্রয়াগের মতো উত্তাল হয়েছিল,
আমার পাশবিক ভ্রূকুটি টুকু
নিস্তেজ করে দিয়েছে তোমার পরশ
আবার ঘাসের শব্দ শুনে শুনে আমি যাই সেই দরজায়।

গুচ্ছ কবিতা।।তৈমুর খান ।।

সমস্ত যুদ্ধের পর   অনেক মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকা  হেসে ওঠে মাঝরাতে  কোনও পিয়ানোর সুরে  খোলাচুল উড়ে আসে তার  বুকের ভেতর থেকে জ্যোৎস্নার ফণা ...