January 30, 2022

মীরা মুখোপাধ্যায়

 হামাম


পয়ঃপ্রনালী দিয়ে বয়ে আসছে সুবাসিত জল,
শীতের সকালে ভাপ উঠছে জল থেকে।
ফুলের নির্যাস দিয়ে চুল ধোও তুমি
তারপর জল ঠোঁট বেয়ে, বাহুমূল, স্তনসন্ধি ধুয়ে...

তুমি খুব ভোরে উঠে স্নান  সারো,
হামামে এলেই তুমি আমি টের পাই,
বুরুজের পাশে এসে বসি।
ভিক্ষাপাত্র ভরে তুলি হামামের বেয়ে আসা জল,
তোমাকে  দেখিনি কিন্তু  তোমার গন্ধ চিনি  আমি
পয়ঃপ্রনালীর জল জিভে দিয়ে শীৎকার করি।
তোমার স্নানের দৃশ্যে কোনদিন থাকতে পারবো না,
পয়ঃপ্রনালী দিয়ে বেয়ে আসা জল
ক্লেদ, গ্লানি, প্রেম আর শরীরের নুন
এই নিয়ে বেঁচে আছি, একা এই বুরুজের পাশে


সব্যসাচী পণ্ডা

 পূর্ণিমা

  

যেভাবে তুমি আলোর ভাষায় কথা বল

তা আমি জেনেছি কিছুদিন।

তোমার কথায় এক দৃষ্টি অতীত জাদু আছে

চাঁদ জানে সে রহস্যের ডাকনাম...


আজ আকাশে হাতের নাগালে চাঁদ

আমি চাঁদ ধরব বলে মধ্যরাতে ছাদে উঠলাম।



অমিত চক্রবর্তী

জমা লহরী, অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠ


অন্ধকারে যখন বরফ জমে সেই লেকে, স্তব্ধ স্রোতের বাতাস

একটু গরম থাকে, জমা জলের লুকোনো তাপ পেয়ে।

এই ধরণের উষ্ণ বাতাসে আমি চাইলেই ভাসতে পারি

প্রাচীন কামানের মত, বারুদ নেই, গোলাগুলি নিঃস্ব,

শুধু দর্শক মাতানো সংবাদ এখন, সার্কাস সার্কাস।

প্রতিটি জমা লহরী এখানে এক ধরণের সঙ্গীত,

সেই যে তুমি বলেছিলে সামারে, পালগুলো খুলে নাও

রঙচটা নৌকোটার, নিষ্ক্রিয় ঘুরুক সে এবার এলোমেলো –

 

সেই সব অন্তরঙ্গ, ঘনিষ্ঠ কথাগুলি ইনকিউবেট করেছে

বুকের গরমে, পুঙ্খানুপুঙ্খ সাজানো আছে এখন

তুষারলিপি সঙ্কেত বা তথ্যের বাহারে। শব্দ এখানে দ্রুত যায়,

ভাষা টপকে, উপভাষা, ডায়ালেক্ট, বাগধারা টপকে

দ্রুত যায়, আচমকা হামলা আসে ইমেজারি সংলাপ

অথবা আর্তির। ডেসিবেল আবার বাঁধ পেরোয়,

বালির বস্তা, লেভি ছাপিয়ে।

 

এ অঞ্চল তাহলেও আমার খুবই প্রিয় রয়ে যাবে,

জমা লেকটিও দেখি বন্ধুসুলভ,

তার নাম রেখেছি দধীচি।


রবীন বসু

আমাদের মাধুকরী



তীব্র শিস ছুটে এলো ধমনী ছিঁড়ে

প্রবাহ প্রদাহ দ্যাখে আক্ষরিক ক্ষত

গভীরে প্রোথিত সুপ্ত শিকড়ের বীজ

অতিক্রম তাকে রাখে নবতর গান।


মূর্ছনা সংগীত নয়, যাপনের লেখা

চর্যাপদ ভেদ করে 'চোরাশি সিদ্ধা'

কাহ্নপাদ শবরপাদ আর নৈমিত্তিক

এই যত গূঢ়াচার গোপন সংকেত


ভবিতব্য প্রতিলিপি বর্ণালেপ আঁকে।


সভ্যতার ক্ষীণ কটি সুচারু বিন্যাস

সময়বাহিত হয় উড়ান অধীর;

প্রতি খাঁজে জল জমে, সঞ্চিত জীবন

আমাদের মাধুকরী ভিক্ষালব্ধ ধন।



সমাজ বসু

 চক্ষুদান


সেই কবেকার ডাকের সাজে মিথ্যার প্রতিমা---

চক্ষুদান বোধন আমন্ত্রণ কিংবা আরতি

সবই চলছে। 

কি অসম্ভব রঙচঙে উৎসবে মেতে আছি---

শ্লাঘায় ভণিতায় আলোর অভাবে নেমে আসছে

অন্ধকারের প্রলেপ---


অন্ধকারে ভুলে গেছি---

সত্যের কাঠামোয় মাটিই পড়ছে না, প্রতিমার চক্ষুদান কিসের?


অনঞ্জন

ঋণখেলাপি


দাম্ভিক যৌবন

তোর সম্ভোগের পালা সাঙ্গ হলে একটু বৃক্ষের কাছে আসিস

দেহের ভেতরে রাখা আগুণ আর বন্য হাওয়ার অনেক ঋণ

সে ঋণ শোধ হবার নয়, তাই বৃক্ষের কাছে হাঁটু গেড়ে বস,

সবুজের সজীব মত্ততার সম্মোহন তোকে বিহ্বল করলে

বৃক্ষের কাছে প্রার্থনা কর- একটু প্রজ্ঞার জন্যে, ওরে ঋণখেলাপি,

তাকিয়ে দেখ- সমস্ত সবুজ আর অফুরন্ত সজীবের দিকে,

হে দাম্ভিক যৌবন, মনে রাখিস- তোর সঙ্গে শুধু তুইই আছিস,

চোখে ধুলো দিবি? সে হবার নয়, এরকমই এক রাতে শুনবি

তারাদের অট্টহাসি, তখন অনেক দেরী, সমস্ত ঋণ রইল পড়ে।


 

          

পলাশ দাস

যেখানেই যাই 


যেখানেই যাই 

দুদণ্ড দাঁড়াই 

গল্প ভাসিয়ে দেন মূর্ত মানুষ

সভাঘর গমগমে 


জামা পরা শব্দ

জামা না পরা শব্দ 

হেলে বসে থাকা শব্দ 

সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বসে থাকা শব্দ 


কোনো কোনো শব্দ বলে ওঠে,মশাই,  

একটু এদিকে, না না এদিকে

আরেকটি শব্দ বলে ওঠে একটু ওদিকে,ওদিকে  

বোঝেন না সোজা ভাষা 

সব হেলদোল থেমে গেলে ঘরময় 

কেনা ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে উঠলে  

সেইসব মূর্ত মানুষেরা বলে ওঠে 

জানেন এরা সোজা উঠেছে 

অনেক মাজাঘষার পর 

শুনতে শুনতে শূন্যে ভেসে ওঠে খাল

কোনো এক বর্ষার জল সেই ফাঁক গলে 

ভেসে যায় সাজানো বনানী অঞ্চল  


                                                        

সৌগত মুখোপাধ্যায়

 একটি প্রেমের কবিতা

                 

যেখানে মেঘের পাশে লেখা থাকে নক্ষত্রের আয়ু

কোনো এক বিষণ্ণ রজনীর নীল বাতির মতো ,

অবশেষ পড়ে থাকে মৃত কুয়াশার ছাই হয়ে ; 

তোমার ভারহীন নতনেত্রের কাজলের মায়ায় 

লেগে থাকে সেই ছাই; অবসাদের ঘোমটা !


সেদিনও বিকেল ভরা আগুন ছিলো শিরায় 

ভীষণ অরণ্যের দাবানল জুড়ে উন্মাদন 

শেষ পাতার আর্তনাদ রক্তে এনেছিলো জোয়ার

তোমারই সর্বনাশী ইশারার স্পন্দনে

মনে পড়ে ?


তবুও হাতের ওপর ছিলো হাত

ঠোঁটে ঠোঁট, বুকে ছিলো বুক 

কী দারুণ নরম রক্তিম ছিলো স্পর্শ 

জ্যোৎস্নার মায়াবী আস্তরণে আমরা 

অনন্ত চিতার আগুনে পুড়েছিলাম অবিরাম

বিস্রস্ত লজ্জার আভরণ পড়েছিলো খসে...


হে বিগতসম্ভবা নারী, 

জানি আজ বিস্মৃত তুমি আগামীর আহ্বানে !

আমি শুধু নিদ্রাহীন ক্লান্ত প্রতি রাতে

আজও দেখি পুড়ে যায় কোজাগরী চাঁদ 

আর পড়ে থাকে কুয়াশায় ছাই হয়ে

আমাদের ভালোবাসাবাসি !



হামিদুল ইসলাম

 কখনো মেঘ                                           

এখন হাওয়া নেই

রোদে ভাসে রুক্ষদিন

লম্বা ছায়া পড়ে থাকে নির্জন বদ্বীপ জুড়ে 

পাঁজরের অস্থিতে নোঙর করি সঙ্গম। নীল অন্তর্বাসে ঢাকা সৃষ্টিসুখ ।।


যতোদূরে যাই 

ফিরে আসি ঠিক ততোটা পথ 

দুঃখ বেদনার গোঁসাঘরে খিল আঁটা পৃথিবী 

আমার ঊনিশের কবিতা প্রতিদিন ফুল হয়ে ফুটে ওঠে সারা ব‍্যালকনিময় ।।


বন্ধুত্ব ছুড়ে ফেলি 

বিভেদের চিতায় পোড়ে ইতিহাস 

কোমল সোহাগ মাখি দুঠোঁটের নীরব কথকতায় 

শূন‍্য হৃদয়ে ভাসে মহুয়ার দেশ। দোপাটি ফুলে গুঁজে রাখি বৃষ্টিমাখা কৈশোর ।।


রাস্তায় ঘাতক অন্ধকার 

প্রতিদিন লুট হয়ে যায় চেনা চেনা ডাকনাম। আমাদের উৎসব রজনী ।।





অজিত কুমার জানা

 চুম্বক 

বৃত্তের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে, 

ঘড়ির কাঁটায় দেখি বারোটা বাজে।

পরিধি ভাঙার হাত নেই, 

জলে তেলে মিশে গেছে সব।

অজান্তেই লেখা হয়ে গেছে,

ডায়রির সব পাতা।


পৃথিবীর মানচিত্রে কত ছবি,

ত্রিভূজ, চতুর্ভূজ, আয়তক্ষেত্র, বর্গক্ষেত্র। 

যেটাই আঁকতে যাই, 

সবই বৃত্ত হয়ে যায়।

বৃত্তের ভেতর থেকে বেরুতে পারিনি,

কেন্দ্রবিন্দু চুম্বকের মত টানে। 






অভিষেক ঘোষ

 ফুল

ভাঙো ফুল ভাঙো, 

ভেঙেচুরে মিশে যাও মাটির শরীরে ।

বর্ষণে সোঁদা গন্ধ হও, কীট-দেহে পুষ্টি হও 

বিস্বাদ বালিদেহে মিশে থাকো 

জীর্ণ অবশেষ হয়ে, খুব ভোরে ।

যে পথে বিকাশ, সে পথেই মৃত্যুর প্রকাশ -

এমন ক্ষতিকর ধৃতি, রঙিন স্বচ্ছদেহে অবসাদ আনে ।

নষ্ট হয় পাপড়ির বিচিত্রবর্ণ মন্তাজ ।

এ যেন কালের কুহর; ছিঁড়ে ফেলে সুন্দর, এক টানে ।

ফুলেরা অলীক হয়, মরে যায় দেয়ালায়,

ঝরে যায় নীরবে, হাসতে হাসতে ।



জয়িতা চট্টোপাধ্যায়

রেখে যেতে হবে


কালকের ঝড়ে গাছটা ভেঙে পড়েছে আমি শুধু ওকে জাগিয়ে তুলতে চাইছি, যে ভাবে আমি ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েও আবার উঠে দাঁড়ালাম, কারণ আমাকে রেখে যেতে হবে শত শত কবিতা বরফের নিচে, রেখে যেতে হবে পাঠকের উদ্দেশ্যে জেগে ওঠা গাছ, আবার আনো কান্না ধোয়া বৃষ্টি

আমার মৃত্যুর দিন আজ। 







শ‍্যামাপ্রসাদ সরকার

গৃহস্থালি 

তুমি আগে আসবে জানলে নিজে গুছিয়ে রাখতাম
সেই জলজঙ্গলের গৃহস্থালি আমার!

তুমি যদি ঠাট্টা করে সোঁদরবন বলতে চাও, বলো!
আমি মউলীর ধৈর্য‍্য ঠিক বুকে রেখে দেব।

তুমি তখন দলঘাসের গালচে দেখে হাসবে ঠিক
আর সুদূর ঝরনার জলে ভাসাবে যৌবন!

তবু গাঢ় কলমীলতায় আর চক্রমুখী শামুক
সাজিয়ে রাখব বনজ‍্যোৎস্নায় একা অন্ধকারে,

অজস্র নদী,খাঁড়ি...এসব তোমার নিশানা হলে
আমি তাদের দেব নিরন্তর জোয়ার-ভাঁটার গান

আরো দূরে করুণাক্ষ গাঙের দেশে তখন নাহয়
জ্বলজ্বলে চোখে জেগে থাকব শার্দুলের প্রত‍্যশায়!

তুমি তার চেয়ে বরং আমার ভিতর বাসাতেই এস 
আর জলছাপ রেখে যেও লক্ষ্মীর পায়ের পাতায়...


গুচ্ছ কবিতা।।তৈমুর খান ।।

সমস্ত যুদ্ধের পর   অনেক মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকা  হেসে ওঠে মাঝরাতে  কোনও পিয়ানোর সুরে  খোলাচুল উড়ে আসে তার  বুকের ভেতর থেকে জ্যোৎস্নার ফণা ...