October 28, 2020

সম্পাদকীয়

 "মহুয়ার দেশ" উৎসব সংখ্যা প্রকাশিত হল।এই সংখ্যাটিকে সমৃদ্ধ করবে মারাঠি কবি অরুন কোলাটকারের অনুবাদ কবিতা।সাম্প্রতিক ধর্মীয় জীবনের প্রেক্ষাপটে তাঁর কবিতা গুলি বিশেষ ভাবে আলোচ্য।তাঁর স্যাটায়ার ধর্মী কবিতাগুলি অন্ধ ধর্ম বিশ্বাসের মূলে কুঠারাঘাত করেছে।"The Low Temple" কবিতায় যুক্তিবাদী এক নাগরিক এবং নিষ্ঠাবান ধ্রুপদী পুরোহিতের কথোপকথনের মধ্য দিয়ে একাধিক অনুপম চিত্রকল্পে সূক্ষ্ম ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অন্তঃসারশূন্য ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি সহজ সরল জীবনের জয়গান।অন্ধকার গর্ভগৃহে দেশলাই কাঠির আলোয় উজ্জ্বল দেবী মূর্তির হাতের সংখ্যা নির্ণয়ে মতভেদ কিংবা মন্দিরের বাইরে বেরিয়ে চারমিনার ধরিয়ে যুক্তিবাদী সেই নাগরিক দেখেন কুড়ি ফুটের কচ্ছপের ওপর ক্রীড়ারত শিশুদের অনাবিল আনন্দ। রূপকাশ্রয়ী কবি ভগবান বিষ্ণুর কূর্ম অবতারের পবিত্র বিশ্বাসের অবনমন ঘটিয়ে ঘোষণা করেছেন "The joy of human life."


"জেজুরী" কাব্যগ্রন্থটির প্রতিটি কবিতাই আক্রমনাত্মক,কখনও সূক্ষ্ম বক্রোক্তির চিত্ররূপময় চাদরে,কখনও কাঁটার মতো বিদ্ধ করেছে সোজাসাপটা। "মকরন্দ", "যশবন্ত রাও", "চৈতন্য" কিংবা "মনোহর" প্রভৃতি কবিতা গুলি স্বমহিমায় প্রাণবন্ত ।"যশবন্ত রাও" কবিতায় "irony" তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে।

"Are you looking for a god?

I know a good one.

His name is Yeshwant Rao

and he’s one of the best.

Look him up

when you are in Jejuri next.


Of course he’s only a second class god

and his place is just outside the main temple.

Outside even of the outer wall.

As if he belonged

among the tradesmen and the lepers."

                                      "Yeshwant Rao"


 অন্যদিকে,মুম্বই শহরের কসমোপলিটন আবহে "কালা ঘোড়া" কাব্যগ্রন্থে  সুররিয়ালিস্টিক জীবনের যে খন্ডচিত্র কবি দেখিয়েছেন তাতেই কুয়াশা মোড়া কালো আচ্ছন্ন দিকগুলিকে ঘিরে ধরেছে মায়া নগরীর একটা একটা মিথ,অব্যক্ত কংক্রিটের ঘেরাটোপে উন্মুক্ত আকাশ। 


অরুণ কোলাটকার ভারতীয় ইংরেজি কবিতায় অন্য ধারার সূচনা করেন।অথচ এই কবি  বিস্মৃত প্রায়।

"মহুয়ার দেশ" উৎসব সংখ্যা কবিকে স্মরণ করে উৎসর্গ করা হল।পাঠকসমাজে কবির সম্বন্ধে সামান্য আগ্রহ সৃষ্টি করলেই আমাদের পরিশ্রম সার্থক। 

পরিশেষে জানাই,"মহুয়ার দেশ" উৎসব সংখ্যার প্রচ্ছদটি করেছেন শঙ্খ চক্রবর্তী। 


অভিষেক সৎপথী, 
সম্পাদক, 
মহুয়ার দেশ



পামেলা পতি

 একটা জীবন তোমায় ছাড়া(২০১৯) : মনখারাপ আজ নস্টালজিয়া


কবি স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর লেখা "একটা জীবন তোমায় ছাড়া" কাব্যগ্রন্থটি বিরহ বিষাদের চেনা পরিচিত গলির মুখে এনে দাঁড় করায় পাঠককে। প্রত্যেকটি কবিতায় ফুটে উঠেছে মানুষের দ্বীপসম অবস্থান; পথ চলতে গিয়ে যাদের একসময় হাত ধরে হাঁটার অভ্যেস ছিল, ডাকনামে ডেকে উঠতো যারা একে অপরকে, এই কাব্যগ্রন্থ উঁকি দেয়  তাদের বর্তমান নিঃসঙ্গ বারান্দায়। ভাষা দেয় মানবমনের সেইসমস্ত গোপন ঠিকানার, যা ভুলে গিয়ে মানুষ নিজেই একসময় বাড়ি ফিরে উঠতে পারেনা। বেঁচে থাকে নতুন ঠিকানায়,ছন্নছাড়া বিষাদ সুখে।

মানুষ বেশিরভাগ সময়ই প্রিয়জনের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনা। কেন জানেন? যে মানুষগুলো আমাদের সামনে হেঁটে চলে বেড়ায়, কথা বলে, স্পর্শ করে, তারা এক লহমায় এসব দায়দায়িত্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। আমাদের অল্প একটু অভিমানে অনিচ্ছা সত্ত্বেও যারা বহু আবদার মেটাতে পারদর্শী ,তাদের নিথর দেহ বিনা নোটিশে মন থেকে সব আবদারের ঘর খালি করতে বলে। নিজের ছোট্ট খোকাকে একটু সময় না দেখতে পেয়ে যে মা সারা পাড়া তন্নতন্ন করে খুঁজতো এবং খুঁজে পাওয়ার পর নিজের কষ্ট উজাড় করতে ঘা কতক দিয়ে বসতো, সেই মা ই যখন কোনও কারণে খোকাকে ফেলে জীবন থেকে মুক্তি নেয়, তখন খোকার শত অভিমান, অঝোরে কান্না কোনোকিছুরই দাম থাকেনা তার কাছে। মৃত্যু পরবর্তীকালে আমাদের প্রিয়জনেরা ঠিক এতটাই নিষ্ঠুর। 

এ তো গেল মৃত্যুরূপী বিচ্ছেদের কথা। কিন্ত একই গলিপথ বেয়ে যারা ফিরতো একসময়,হঠাৎ কোনও ঝড়ে এক ধাক্কায় যাদের পথ আলাদা হয়ে যায়, নিজেরা নিজেদের মনের দরজায় চাবি দিয়ে রাস্তায় আবার নামে একাকী, কে ভোলায় তাদের? আচ্ছা, মৃত্যু পরবর্তী বিচ্ছেদ যদি পূর্ণচ্ছেদ সম হয়, মানুষের আবেগী মন কী কখনও এই এক দুনিয়াতে থেকেও  একইসাথে না থাকার গল্পে পূর্ণচ্ছেদ মেনে নিতে পারে? নাকি তারা বেঁচে থাকে কোনও এক কল্পনার সেমিকোলনের আশায়? নাকি তারা ঠিক করে নেয় "দূর হতে আমি তারে সাধিব/গোপনে বিরহডোরে বাঁধিব"? 

         শহর এবং শহরতলির জীবনযাপন আলাদা হলেও দুটো পরিণত মানুষের পরস্পরের প্রতি আবেগের গল্পগুলোয় বড্ড বেশি মিল; জায়গার ব্যবধানে যুগের ব্যবধানে এই আবেগের খুব একটা অন্তর নেই। পাল্টায় শুধু আবেগের বহিঃপ্রকাশ। ভেতরের চুপিচুপি জমা থাকা আবেগ মোটামুটি  

একইরকম। সেই আবেগী দুটো মন যখন একইপথে হাঁটতে গিয়ে তাল মেলাতে পারেনা, তখন শুরু হয় একাকী পথচলা। মৃত্যু হয় নিজের ভেতরে থাকা পুরোনো কিছু পরিচিতির, হঠাৎ করে সে অনুভব করে "ট্রামের শহর যেমন করে অটোর হল/তেমন করে আমিও হলাম তোমায় ছাড়া"! শহরতলির গল্পে পাল্টায় শুধু দৃশ্যপট,সেখানেও " তবু তো সেই ফোন আসে না জন্মদিনে/বছর কাটে... ফোন আসে না জন্মদিনে "। পড়ে থাকে " একা বাসস্টপ", "ফাঁকা বাসস্টপ", "মনমরা হাওয়া","ফাঁকা প্যান্ডেল", "শেষ বিকেলের ট্রেন স্টেশন", "ফেলে যাওয়া রুমাল", এবং "শূন্য দীপাবলি"। একটু উষ্ণতার খোঁজে হারিয়ে যেতে বসা মানুষটির শহরেও কিন্তু  শীত আসে । "দীর্ঘ মেলানকলি" র গাম্ভীর্য মুখে মেখেও তার অবচেতন মন বলে ওঠে, "আমি ভয়ে হাত বাড়িয়ে তোমায় খুঁজি। একদিন তোমার সঙ্গে গুটিশুটি ঘুমব  বলে/জেগে থাকি সারা জীবন। " শীতল বাস্তবে চোখ খুলে সে বুঝতে পারে ", লেপ ভেঙে উঠে একা বসে থাকি/ পালক ছড়িয়ে কবে গেল পাখি/আমায় একলা রেখে! / কেউ-নেই-পথ পাইনের বনে হারিয়ে গিয়েছে বেঁকে"। বাস্তব এবং কল্পনার বিস্তর ব্যবধানে শান্তিচুক্তি করতে এগিয়ে আসে ইন্টারনাল মোনোলোগ।শুরু হয় একা একা কথা বলা, জবাবদিহি করার অভ্যেস, ঠিকানা ভুলে চিঠি পাঠানোর সতর্কতা। জানতে ইচ্ছে করে তার, "সেই সত্তর সালে আমাদের দেখা হলে/তুমি কি এমনই নীল রঙের শাড়ি পরে/একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে নির্জন কোনও বাসস্টপে? " কৌতুহলের শেষ যখন হয়না তখন অসহায় আবেগী মানুষ কিছু দূর্বল করে দেওয়া সত্যির মুখোমুখি দাঁড়ায়। এবং তার উপলব্ধি হয় "আসলে জীবন মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে বেঁচে থাকা পাওয়া/সালোকসংশ্লেষ আমি তুমি এর রোদ জল হাওয়া"। 

              " একটা জীবন তোমায় ছাড়া" ভাষা দেয় এমন বহু চিরপরিচিত আবেগকে,যুগবিশেষে বা স্থানবিশেষে যেসব আবেগের বোধহয় সেরকম তারতম্য নেই। উপন্যাসের মতো দীর্ঘ এক পথচলার স্বপ্ন বিভিন্ন কারণে ছোটোগল্প হয়ে শেষ হলেও, শেষের রেশটুকু থেকে যায় আজীবন। কেমন হয় সেই থাকা? কবি স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর এই কবিতা সংকলনের প্রায় প্রত্যেকটি কবিতার আনাচকানাচে ফুটে উঠেছে সেই অপ্রত্যাশিত নিঃসঙ্গ জীবনের কথা, যেখানে টুকরো কিছু গল্পকথা স্মৃতির পাতা থেকে ফিরে আসে বারবার, যেখানে "... যা হলে বেশ হত আর যা হলে বেশ হবে/সেসব আর হবে না কক্ষণও"।

October 25, 2020

গোলাম রসুল

 বালকের বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা 

বালকের বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা
উষ্ণ লবনের মতো বছর
শহরের ওপর দিয়ে হাওয়া টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে একটি গাছের ঈগল
ঈশ্বরের মোমবাতির নিচে নিভে গেছে
একটি দিন

স্মৃতির মতো ধনী বাড়ি
চাঁদের ভূতের আলো
রাত্রির সবুজ
জাঁকজমকপূর্ণ দুঃখের সমারোহের মধ্যে দিয়ে আমাদের নিয়ে চলেছে
অনেক নক্ষত্রদের পায়ে চলা পথ
মাটির গর্ভস্থ সময়
সহস্র দেহের একটি খাঁড়া মানুষ
শিকারী পাখির থেকে তীক্ষ্ণ দেখছে
আমারা শুনতে পাচ্ছি তার প্রস্তর যুগের কন্ঠস্বর

হৃদয়ের দৈর্ঘ প্রস্থ নেই

কে জন্মগ্রহণ করছে
সমবেত আমাদের গর্ভে
আমরা ফেলে এসেছি রাস্তায় ঘুমিয়ে পড়া জনতা

কৃষকের কাক ডাকছে  আগামী ভোরের মাঠে

হায় স্পর্ধিত শহর
মৃত মুখ দিয়ে এখনো কিছু কথা বলিয়ে নিচ্ছ
আর রাজত্বের বালিশে শুয়ে কবর

কি সুন্দর পালকের  স্পর্ধা উড়ছে আকাশে

বহু বছর পরে
বালকের বইয়ের কয়েক পৃষ্ঠা
উষ্ণ লবনের মতো বছর
       

তৈমুর খান

 মাটিতেই বসে থাকি 

সব পাখিরা উড়ে যাচ্ছে 
কথা বলতে এসেছিলাম পাখিদের সাথে 
কথারা পাখিদের পিছনে পিছনে ছুটেছে 

পৃথিবীতে কেউ নেই আমার কথা শোনার 
গাছেরা দিগন্ত ছুঁতে চায় 
পর্বতেরা দেমাকে অটল 
নদীরা তো নাচে শুধু নিজের গৌরবে 

মা নেই 
কাঁদতেও ইচ্ছে করে না 
কার কাছে রাখব অভিমান ? 
দিগন্ত দূরের দেশ আমার ভাষাও বোঝে না 
মাটিতেই বসে থাকি সারাদিন 
এই শতাব্দীর রক্তে ভেজা মাটি… 


নীরেন্দ্রনাথ 

তোমার বাতাসি ডেকে ডেকে চলে যায় 

বাস থেমে গেলে আমরাও নামি 
সামনে অন্ধকার হয়ে আসে পথ 

দীর্ঘ ছায়া পড়ে 

কার ছায়া সংকেতের ভিতরে বাহিরে? 

আমাদের বাস্তবের বাড়ি 
সেখানেই ফিরে যেতে চাই 

তুমি তো নীরেন্দ্রনাথ 
এই চক্রবর্তী পাড়ায় আমরা ঘুরি চক্রবৎ 

সব্যসাচী পন্ডা

 সঞ্জীবনী

শুশ্রূষায় ফিরে আসি বারবার।
পড়ন্ত বিকেলে মন খারাপ ঝরে পড়ছে অস্তরাগে।
তবুও তুমি দাঁতে দাঁত চেপে
আলোবাতির কাছে নত করেছ মাথা
তোমার ভরাট খোঁপা থেকে ঝরে পড়ছে গান
আর আমি সুধা ভেবে
আঁজলা পেতে সযতনে তুলে নিচ্ছি সেসব।

তুলসীদাস ভট্টাচার্য

 আমার বুকের ভেতর 

আমার বুকের ভেতর একটা গ্রাম
আছে সোনাঝুরি শালের জঙ্গল
মহুয়ার গন্ধ পাখির ডানামেলা আকাশ

আমার বুকের ভেতর একটা নদী 
গঙ্গার মতই চিরপ্রবাহিনী 
প্রতি পূর্ণিমায় ফুলে ওঠে জল 
সারারাত চিক্ চিক্ করে ঢেউয়ের মাথাগুলি 

আমার বুকের একপাশে সাহারীয় উষ্ণতা 
ধূসর বালিয়াড়ী পদচিহ্নহীন 
রাত্রিকালীন শীতলতায় হারিয়ে যায় জ্যোৎস্নামুখ 

আমার বুকের ভেতর একটা আমনের খেত 
ধানপোতা আঙুলের ছাপ 
ধানের শীষে শরতের শিশির 
হা- করা কচি ধানের মুখে সঞ্চিত দুধে 
সোনালী স্বপ্ন আঁকা 

আমার বুকের ভেতর ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসী 
আচমনীয় জল ও স্বস্তিবচন 
পঞ্চপল্লবে শোভিত ঘটস্থাপন
ঈশ্বরের আবাহন  
মূর্তির ভেতর জেগে ওঠে কোজাগরী।

বভ্রুবাহন

 পাওয়া 

    

(ভোর)

কাঠঠোকরা অনেকটা কাঠ ফুটো করে দেয়।

ওর তো দোষ নেই,একটা পোকাই খাবে না হয়।

(সকাল)

আদিমতা মোম,যাক,ও তো গলে যায় রোজ।

আলো হয়েছে কিনা দ্যাখে রাজা ভোজ।

(দুপুর)

না হয় সমস্ত বৃষ্টি তে  হল না ধান।

লঙ্কা জল পেয়ে ঝাল আর আহ্লাদে আটখান।

(বিকাল)

মৃত্যু দেখো না আর,আত্মা অবিনশ্বর।

ক্ষিদেকেই বরং পজিটিভ করো ঈশ্বর।

(সন্ধ্যা)

কর্মহীন নিশ্বাস আসলে এক নোংরামি

আমাদের মৃত্যু আনে চুপ থাকা আমি

(রাত)

কি পেলাম,তার হিসেব চেয়ো না কখ্খোনো।

পন্ডশ্রমে ভন্ড ডিম,রাজা খায় জেনো।

(মধুরাত শেষে)

ফল কেন চাও ! মা ফলেষু কদাচন ।

শুধু বসে খাও,হে মূর্খ অকর্মণ্য ।


সুকুমার কর

আমার দম্ভ
     
  আমার দেহে একটা দাম্ভিক
  মানুষ বাস করে
  ঘাড় উঁচু মোরগটা দেখলেই
  জবাই করে
  রসিয়ে রসিয়ে ওটার ঘাড়
  চিবিয়ে খায়
  ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছি আমি

 আশ্রয়
   
 তোমাকে না বলে পাখিটা
 উড়ে গেছে পলাশের বনে
 শোকার্ত মন আশ্রয় খোঁজে
 এ বুক শোকের বাড়ি নয়
 তবু এসো,বুকে ঝাঁপ দাও
 এ বুকে আকাশ পেতেছি
  
 উপবাস
        
 মা খেতে বসবে
 এমন সময় বাড়িতে অতিথি
 "অতিথি দেব ভব"
 মার আর খাওয়া হলো না


পূর্বাশা চক্রবর্তী

আসলে রোদের উঁকি


আকাশ ছোঁয়া এক একটা বাড়িকে কংক্রিট ভাবেনি

ভাবেনি কারণ শক্ত শিকড় আঁকড়ে থাকতে হতো,

সেই জীবনের বন্ধ কাঁচে কালের প্রকোপ এলে

জীবন নামের অদ্ভুত জীবের বাঁচতে শেখার মতো!


জলের বিন্দু ফোঁটায় মাপে তবুর প্রশ্ন খোঁজার

রাতের কাঁটায় ভাসিয়ে প্রলাপ কিসের থেকে বাদ?

সব মানিয়ে ইটের ঘরে আবার প্রশ্ন জাগে

আবার যদি জড়ায় তাঁরা শিকলের আহ্লাদ!


শক্ত ইটের গঠন বাড়ির বারান্দাতেই ঠাঁই 

অদ্ভুত এক গন্ধ শিকড় যত্নে থাকুক পাশেই,

অকাল ক্ষত জানিয়ে গেল আবার হবে দেখা

প্রলাপ আঁকা আঁচড় কাটা ভাঙা ডানায় হাসেই!


খাঁচার পাশে খানিকটা খাদ ওইতো আকাশ সেথায়

পাখির মতো ক্ষীপ্র ডানায় উড়তে এলেই ভোর,

আনাচেকানাচে প্রলাপ ভাসে নজর হলেও ক্ষীণ 

বাধ্য ডানায় জাগবে না মোর বহিরাগতর জোর!


ইচ্ছেগুলোর কংক্রিটে ভয় সামলে রাখার দায়

হঠাৎ করেই বলতে থাকে স্বরের কাঁটায় ঝুঁকি,

নিয়মগুলো গলতে থাকে মোমের শিকড় মাপে

বারান্দাতে আবার কবে আসবে রোদের উঁকি?


গুছিয়ে রাখে খানিকটা রঙ ছোট্ট বাক্স কাঁচের

ইচ্ছেগুলো রাখবে তাতে অপেক্ষাদের ছুটি, 

জীবন যেদিন বাঁচতে শেখে সেদিন শিকল বোঝে

অভিমানরাও জমবে সেথায় আসলে রোদের উঁকি।

                                       

সুব্রত চক্রবর্তী

 নদী জীবন 


ঘরের পাশে নদী না থাকলে জীবন খাঁ ‌‌খাঁ করে।
শীতকালে নদীর চরে মনের শোক শুকিয়ে নেওয়া যায়।
ভরা বাদলে লুকিয়ে রাখা যায় চোখের নিচে কালশিটে দাগ।
নদী শুরুর গল্প জানে
যেখানে পাষাণ পাহাড় গলে বরফ,বরফ থেকে  ঝর্ণা।
নদী অন্তরে বিরহ বোঝে 

অশ্রুলেখা নদী তাই চিরকাল সমুদ্রে মিশে।

নদী প্রেম জানে 
শ্রাবণে নদীর বুকে অবিরাম ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ।
নদী পাড় ভেঙে পাড় গড়তে পারে
আলো ও আঁধারে কারো বুকে নদীর শব্দ শুনে কেউ।

ইন্দ্রাণী পাল

হাত

তোমাকে শেষ কবে দেখেছি
মনে পড়ে না
বোধহয় ঘুমন্ত কোনো ফ্লাইওভারের নিচে
আরো ঘুমে ঢলে পড়েছ
কতদিন হল তোমার জামার গন্ধ শুঁকি না
এই রাত্রিবেলা ঘন অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়ালে
চারপাশে সুবাতাস বয়ে যায়
আর আদিম নক্ষত্রের নিচে
আমরা সবাই এর হাতে ওর হাতে হাত রাখি।

ঋভু চট্টোপাধ্যায়

মাঝ বলে কিছু হয় না      

মাঝ রাস্তা বলে কিছু হয় না, 
ডান বা বাম দিক ধরে কয়েকটা পা
এগোনোর পরেই কৃষ্ণগহ্বর,

গিলে খাচ্ছে হৃৎপিণ্ডের ব্যারোমিটার।

ঠিকরে বের হওয়া আলোর সাথে
টেলিস্কোপিক সহবাসের পরেও
চোখের ঘরবাড়ি অবরুদ্ধ।


তার মানে যেভাবে বুক বলে একটা মাঠ,
ফুসফুস বলে একটা চিমনি আর কিডনি বলে
কতকগুলো ড্রেন গজিয়ে ও বুজিয়ে ফেলবার
চক্করে লোক ঠকাচ্ছে সেখানে দাঁড়িয়ে কোন
পথেরই কোন রাস্তা নেই,হয় ডান বা বাম,
মাঝ বলে কিছু হয় না।

অনুবাদ কবিতা:অরুণ কোলাটকারের কবিতা

অরুন বালকৃষ্ণ কোলাটকার (১৯৩২-২০০৪) ষাটের দশকের মারাঠি কবি।মারাঠি এবং ইংরেজিতে লিখেছেন।বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ "জেজুরি" (১৯৭৬),যার জন্য পরের বছর তিনি কমনওয়েলথ পোয়েট্রি পুরস্কার পান।পোস্ট মর্ডান এই কবির কবিতা ভারতীয় কবিতাকে এক ভিন্ন ধারায় পরিচালিত করে।

অনুবাদক অভিষেক সৎপথী।


মনোহর

দরজাটি খোলা
মনোহর ভেবেছিলো
হয়তো আর একটা মন্দির।

ভিতরে গিয়ে
আশ্চর্য হল
সে কোন ভগবান দেখতে চাইছে?

দ্রুত পিছু ফিরলো
একটি বাছুর প্রশস্ত দীঘল চোখে তার দিকেই চেয়ে

এটা তো  কোনো মন্দির হতেই পারে না
সে বলেছিল
এটা শুধু একটা গোশালা,আর কিছু না।


চৈতন্য

চৈতন্য বলেছিলেন জেজুরির পাথরগুলি
আঙুরের মতো মধুময়।

সেই পাথর মুখে নিয়ে  কড়মড় করে চিবিয়ে
তিনি থুতিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন ভগবানের দিকে।


( শ্রী চৈতন্যদেব মহাপ্রভু ১৫১০-১১ খ্রিস্টাব্দে
জেজুরির খান্ডোবা মন্দির ভ্রমণ করেছিলেন।)


গর্ভ মন্দির

গর্ভ মন্দিরে ভগবান আঁধারেই থাকে।

তুমি পুরোহিতের দিকে একটা দেশলাই বাড়িয়ে দিলে
এক এক করে মূর্তিগুলি আলোর সামনে আসে।

চমকিত ব্রোঞ্জের ঔজ্জ্বল্যে
স্মিত পাথরগুলো বিস্ময় রহিত।

দেশলাই কাঠির জ্বলে ওঠা আর নিভে যাওয়ার
মধ্যবর্তী  প্রতিক্ষণ
কাঠামো গুলি আসে
আর অবয়ব ছায়ায় হারিয়ে যায়

তুমি জিজ্ঞাসা করলে,"এটা কোন মূর্তি?"
পুরোহিত জানালো "দেবী অষ্টভূূজা।"

কাঠিটি নিভে এলো

তুমি হাতগুলো গুনলে
প্রতিবাদ করে বললে,"না,অষ্টাদশভূজা।"

সবকিছুই এক,পুরোহিতের কাছে আটটিই হাত!

বাইরের আলোয় বেরিয়ে এসে একটা চারমিনার ধরালে।
ছেলেগুলো বিশ ফুটের কচ্ছপের ওপর খেলা করছে।


চ্যুতি রেখা

কোনটা ভগবান
আর কোনটা পাথর

বিভাজনকারী কোনো লক্ষণরেখা
যদি থেকে থাকে
জেজুরিতে সে রেখা ক্ষীণ,
প্রতিটি পাথর হয় কোনো দেবতা না হয় উপদেবতা।

ঈশ্বর ছাড়া আর অন্য কোনো ফসল নেই
সারাবছর ধরে শুধুই ঈশ্বর  ফলন
সারাদিন সারারাত শুধুই ঈশ্বর
মাটি  উষর অনুর্বর
শক্ত পাথর পাহাড়

শয়নকক্ষের মতোই
দৈতাকার পাথর খন্ডটিই
শাপগ্রস্তা খান্ডোবা পত্নী

আর এই ডানদিকের ফাটলটিই হলো
খান্ডোবার বিশাল তরবারির দাগ।

তিনি একদিন তাকে ভূপাতিত করেন
ভয়ংকর ক্রোধ স্বরূপ

পাথরে আঘাত,এই ফাটল,চ্যুতি রেখা
এবং পবিত্র ঝর্ণাধারার উৎস রেখা।

(খান্ডোবা শিবের আর এক রূপ।অন্য নাম মার্তন্ড,ভৈরব ,মাল্লারী এবং খান্ডুরাও। মূলত: মহারাষ্ট্র এবং কর্নাটকের কিছু অংশে উপাসনা করা হয়।)

গুচ্ছ কবিতা।।তৈমুর খান ।।

সমস্ত যুদ্ধের পর   অনেক মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকা  হেসে ওঠে মাঝরাতে  কোনও পিয়ানোর সুরে  খোলাচুল উড়ে আসে তার  বুকের ভেতর থেকে জ্যোৎস্নার ফণা ...