October 30, 2022

মীরা মুখোপাধ্যায়

 আমার জন্য কোনো ভালো খবর থাকতে পারে না


'তুমি বলেছিলে একটা খবর আছে '

আর আমি দৌড়াতে দৌড়াতে শহরের শেষ প্রান্তে

গিয়ে শুনি

সুচরিতা মারা গেছে 


টালমাটাল সময়ে দাঁড়িয়ে বড়বাবু ফোন করলেন

'একটা খবর আছে সুকান্ত '

গিয়ে শুনি স্ট্রাইকের অজুহাতে 

আমাদের চাকরি গিয়েছে


আজ, দেখা হলে সম্পাদক বললেন

'একটা খবর আছে আপনার '

আমি খুব শান্ত ভাবে বললাম

যে লেখাটা ছেপেছেন সেটা আমার না,

অন্য কোনো সুকান্ত সেনের

কারন, আমার জন্য কোনো ভালো খবর

থাকতে পারে না


তৈমুর খান

১.

কাঙাল 

একটু স্নেহ হবে? 

এতকাল শুধু কুয়াশায় হেঁটে হেঁটে 

কোথাও বিশ্বাস খুঁজে পাইনি 

মানুষেরা অরণ্যে গেছে, সভ্যতা এখন অরণ্যনগর 


রাস্তার বিজ্ঞাপনে কত পান্থশালার নাম 

কত সুশাসকের স্ট্যাচু এখনও বক্তৃতা দিচ্ছে 

চারপাশে এখনও কত হাততালি 


আমি অন্ধকার মেখে গড়াচ্ছি কুসুমের দিকে 

কুসুমের নরমগালের রোদে কত স্নেহ ঝরে 

পৃথিবী মাতাল হয়, সভ্যতা স্বপ্ন বিলি করে 


দু’দণ্ড বসতাম পাশে 

কয়েক কদম হেঁটে গিয়ে 

আমার মৃত মায়ের জায়নামাজে ঘুমোতাম 

কখনও কোনও পাখি ডেকে দিত ভোর হলে 

জল নিয়ে ফিরত কোনও নারী নীরব স্নেহের হ্রদে 


আজ যদি বিশ্বাস এসে কাছে দাঁড়ায় 

আজ যদি প্রসারিত হাতে বিশ্বাস বলে :

দ্যাখো, কোনও অস্ত্র নেই….. 

স্নেহমাখা কুসুম তোমার অপেক্ষায় আছে! 


২.

তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে অস্তিত্বের উপর 


গৃহস্থ মাছেরা এসে দরজা ধাক্কায় 

আমার আদৌ কি কোনও দরজা আছে? 

এই সলিলে, সময়ের বিমর্ষ সলিলে ডুবে আছি 

তরঙ্গ বয়ে যাচ্ছে অস্তিত্বের উপর 


দাঁত, মুখ এবং কামড় একসঙ্গে এগিয়ে আসে 

আত্মরক্ষার কিছু নেই 

অতি সামান্য ভঙ্গুর কল্পনার বাড়ি 

বাক্-বিতণ্ডায় দরজা নির্মাণ —


মাছেরা ঘাই মারে 

বৃহৎ পুচ্ছ তাড়নায় কেঁপে ওঠে আশ্রয় 

কার তবে বন্দনা করি? 

এই জলে কোথায় আছ জলেশ্বর ? 

৩.

আমার কোথাও বাড়ি নেই 


ছেলে কোলে বসে আছে মেঘ 

বাড়ি খুঁজতে খুঁজতে আমি ফিরি 

সমস্ত আকাশ জুড়ে মেঘের কলোনি 

এগলি ওগলি পথে কত না কাহিনি 

শব্দের নাকছাবি পরে বসে আছে 

কল্পনার রানি 


আমার কোথাও বাড়ি নেই, দৃশ্যত অবলম্বন শুধু 

যে ডাকে তার কাছে যাই 

নক্ষত্রের গান শুনি 

জ্যোৎস্নায় যদি কারও ছোঁয়া পাই 

হিল্লোল নিয়ে এসে তবে 

ধারণায় নির্মাণ করি নতুন আশ্রয় 


কোনও কোনও বৃষ্টির রাতে 

দেখি ফিরে আসে মনের জানালায় 

অতীত স্মৃতির ধ্বনি 

আমি তার কাছে আমার সমস্ত চুমু রাখি 

আমি তাকে আবার নতুন জাগরণ পাঠাই








হামিদুল ইসলাম

দুপুর 

ছায়াডোবা স্বপ্নজালে
রঙের রোশনাই 
আমরা প্রতিদিন ছুঁয়ে দেখি ফুল পাতা জীবন।

তখনো আমার একলা বিকেল 
স্মৃতির কোঠায় খুন হয় হাজার চাঁদ 
চাপ চাপ রক্ত 
চাপ চাপ কষ্ট 
হৃদয়ের ভেতর।

তাবৎ কষ্টের মাঝে ভিজে ওঠে বুক
দুহাতে কুড়োই স্বপ্ন
দুহাতে কুড়োই বাসি ভাত ।

হাজার হাজার ভূখাপেট হাভাতের বিবর্ণ দুপুর খুঁটে খুঁটে খায়।

মাটি

কবিতার বীজধান পুঁতি 
আউশের ক্ষেত ভরে ওঠে বিশ্বাসে 
সব বোধিবৃক্ষ 
ধ‍্যানমগ্ন বুদ্ধ 
নৈরঞ্জনার পূণ‍্যতোয়া জলে ধুয়ে নিই আজন্ম নীতিকথা ।

কারা আসে কারা যায়
নদীর জলে ভাসে কাঠ কয়লা আকরিক 
আমরা দেখি শুনি। হিসেব মেলাই 
তবু জন্ম নেয় নাস্তিকের দল 
আমরাও ধীরে ধীরে বারবার বারবার নাস্তিক হয়ে যাই ।

পাপ পূণ‍্যের নতুন সংজ্ঞা সাজাই 
বার্ধক‍্যের লাঠি হাতে দেখে নিই জীবন 
উঠতে মাটি 
বসতে মাটি 
মাটি খায় কাঠ কয়লা আকরিক। মাটি খায় জীবন ।

পুরোনো বসত
                             

আমাদের সমস্ত দুঃখ কষ্ট আর যন্ত্রণা
মাঝে মাঝে ধুয়ে নিই জলে 
ডুবজলে ভাসে কথা। সূর্যের ছায়া নামে বৃহৎ দ্রাঘিমায় ।

আমাদের হৃদয়ের গভীরে পুরোনো সম্পর্ক 
বারবার ফিরে আসি সেঁজুতি বলয়
কুসুমিত মল্লভূবনে নৈরাজ্যের ছায়া। জমে ওঠে বিস্ময় একবুক ।

পড়ে থাকে জলের পুরোনো বসত 
নাবাল জমিনের ঘ্রাণ 
হরদিন পাতার কুটিরে আঁকি তারুণ‍্যের উচ্ছ্বাস। নৈঃশব্দের আদিম রাত।

হরদিন অন্দরমহলে খুঁজি 
অশ্বমেধ ঘোড়া। সমিধ আয়তক্ষেত্রে পুঁতি নির্জলা কবিতার বীজধান।


পাথর                        ্

এখনো নিজেকে খুঁজি 
এখনো খুঁজি আমার আমিকে 
আমি শূন‍্য 
অতীত   

আমার হাতে জিরাফের দাঁতের দাগ 
রক্তাক্ত জীবন 
জিরাফ অসুখ 
বারবার শাদা খামে তুলে রাখি স্বপ্নের উপমহাদেশ  

ভালোবাসার মুর্ছনা শুনি 
শিউলি ঝরা রাত 
ইট কাঠ পাথরে প্রতিদিন ভালোবাসা কুড়োই 

পাথর স্বপ্ন দেখছি 
পাথর হয়ে যাচ্ছে হৃদয়। পৃথিবী পাথর 

পাথর আমাকে চাপা দেয়। আমি চাপা পড়ে আছি জিরাফের পায়ের তলায়।      







নীলম সামন্ত

এবং কিন্তু অথবা

১.

বায়বীয় পাগলামির শেষে আলো জ্বালতেই 

ফুসফুসে ঢুকে পড়ল

parrot of life cycle 


২.

জীবন কোন ভিক্ষার দান নয় 

হতে পারে একটা মিসড কল 

কিংবা আশাবাদের কারখানা


৩.

আকাঙ্খার পরবর্তী আলোকপাত 

অপ্রকাশিত সুড়ঙ্গ 

যত রহস্য 

ততই চুম্বকত্ব 


৪.

আঘাতটুকুই দেখলে

হ্যাশট্যাগে পৃথিবী তোলপাড় 

অবসাদের গুদামঘর 

এড়িয়ে গেলে 

নির্দ্বিধায় 


৫.

We can share a cup of coffee 

Instead of red wine 

বর্ষার শেষরাতে 

গেট কিপার উপেক্ষা করে ঢুকে পড়ছে 

সিংহের গর্জন 


৬.

গাঁজা গাছটা মরে গেছে 

নেশার জন্য ছাদ ও মাদুরই যথেষ্ট 

তুমি ত্যাগ লিখবে 

আমি লুডোর ডাইসে তিন ছক্কা  

পায়ে পায়ে চলবে অতর্কিত বিশ্বযুদ্ধ...







অংশুদেব

 মা এক নির্মল আলো


ঘুমের মধ্যে ভেঙে যাচ্ছে পথ

শকুন উড়ছে

একাকী বালিকা পাহাড় গুহায়

আলোয় আলোর মালা গাঁথে।

খুব ক্ষিদে...

মাথায়

বুকে

পেটে

আর...

সূর্যের মিতালী বৈকালিক রঙে।


জীবনটা একটা বোঝা

বাপের দেওয়া

মায়ের দেওয়া

দেওয়া যাদের

নেওয়া তাদের

হিসেবের খাতা ঘিরে পাথর সময়

শীতের হিমে জাগে জীবন কবিতা !


তবুও বালিকা যুবতী হয়

আলোর ছবি আঁকতে গিয়ে

স্মৃতির পাতায় পাতায় কালো।

যুবতী মা হয়ে সেই অন্ধকারে

অন্ধকার ছিঁড়ে ছিঁড়ে টেনে দিল

এক নির্মল আলোর অমৃত আভরণ!


  জানুয়ারী ২০২২

চম্পাহাটি 








সোমনাথ সাহা

আপনজনের পদাবলি


"যদি না থাকত এই জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর প্রতাপ জীবনে,

আমিও খুঁজতাম সুখ, যা কিছু সে রমনীয় রুচিকর মনে।"

                                      ( বুদ্ধচরিতম্ , বন্দনা )

বাবা

বাবা আমার স্নিগ্ধ বাতাসের মতন, সমস্ত অনুভব দিয়ে তাকে অনুভব করলে বুঝতে পারি,

আমার ছেলেবেলার পাতায় লেখা আছে সেই সময়ের কথা,

যখন বাবা শীতল চাঁদের মতো শিশির ভেজা পথে দাঁড়িয়ে ছিল সৃষ্টির সিন্ধু বুকে নিয়ে; আমরা তখন স্তব্ধতার খোঁজে রাত্রির বুক চিরে চলে যেতাম কালপুরুষের কাছে।

বাবা আমাদের বিশ্বাস দিয়ে মাটির ঈশ্বর গড়তে শিখিয়ে ছিল।

আজ আমাদের নিবিড় সংযমে স্মৃতিটুকু বেঁচে আছে, আর বাবা মিশে আছে অনন্তের গভীরে।


মা

'মা'-কে নিয়ে বলতে যোগ্যতা লাগে!

যোগ্যতাহীন ব্যর্থতার শীতলতা দিয়ে যা বুঝেছি তা হলো-

মা কে দেখতাম বিকেল হলে থালা ভর্তি সন্ধ্যা সাজিয়ে রাখত; আর আমরা চার ভাইবোন একমুঠো আলো ভাগ করতে শিখতাম মায়ের কাছে।

মায়ের অস্থির মন দিনরাত ছোটাছুটি করতো একলব্যের তীরের মতন।

একই জনমে অনেক বার জন্মেছি আমি, তবুও আমার বুকের ভিতর রয়েগেছে অজস্র চোরা ঋণ।

এপারে যা কিছু সঞ্চয়, তা এপারেই রেখে যাবো, তোমার সাথে নিজেকে মিলিয়ে দেবো বলে।


দাদা

স্বাধীনতা আনবে বলে সেই যে কখন ঘর ছাড়া হলো স্বাধীনতা এসেগেলো দাদা এলোনা।

আমি দেখতাম দাদা প্রতিটা অপমানের পর ফিরে আসত সাদা কাগজের বুকে।

গোলাপের রাজনীতি দাদা বোঝেনি কোনোদিন তাই তো তুচ্ছ গোলাপ মাড়িয়ে হেঁটে গেছে লজ্জা হরণ নিদ্রালোকে।

দাদা শেষে একটা চিঠিতে লিখেছিল-" ক্ষমতার দরজায় প্রতিরোধ গড়ে তোলা বারণ"।


দিদি

যতটুকু আমি জানি দিদি কে ওরা বিয়ে করে পশুর মতন কেটে খেয়েছিল।

আর বাকিটুকু মায়ের মুখে নির্জনতার ভিতর রুমাল দিয়ে ছটফটিয়ে কান্না দেখে বুঝতে পারি,

অযত্নে বেড়ে ওঠা শিউলি গাছের শরীর ভর্তি ঘায়ে কারা যেনো শান্তি পাচ্ছে।

দিদির কান্নার জলে আমি আধার হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বুঝতে শিখেছিলাম-

ফুলের গন্ধ ফুরিয়ে গেলে বাতাসও মুখ ফিরিয়ে চলে যায়।


বোন

বোন একজনকে ভালোবেসে বলেছিল-

"তুমি দেখো মৃত জোনাকিদের পাশে আমি গোলাপ ফুটিয়ে তুলবোই।"

বোনের প্রেম ছিল নির্জন নদীর বিষণ্ণতার মতন, হরিনের চোখে মাধুর্যের মতন।

চোখের সামনে অপেক্ষা করতে করতে বোনটি আমার শ্রুতি হয়ে গেলো,

শ্রুতি হতে হতে স্তব্ধ হয়ে গেলো,

আজ হঠাৎ দেখি স্তব্ধ হতে হতে অশরীরী চুম্বন রেখা ছুঁয়ে ফেলেছে।


কুসুম

আমাদের বুকে দোয়েল নেমে আসলেই আমার ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে কুসুম আসতো।

কুসুমের ঠোঁটে অহংকার ছুঁয়ে আমি জ্যোৎস্না ধরার চেষ্টা করতাম; পারতাম না তলিয়ে যেত ভালোবাসার মতন।

রাত বেশি হলে সংক্ষেপে চাঁদ কে ডাকতাম, অন্ধকারে ঠোঁট ভেজানো কথা বলতাম।

২১ শে ফাল্গুন চাঁদ দেখতে গিয়ে হঠাৎ আমি তোমায় দেখে ফেলেছিলাম।

তার পর আমাদের কিছু কথা তোমার কাছে বন্ধক রেখে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলাম অপেক্ষার আলিঙ্গনে।






                                          

                       

দেবাশীষ মুখোপাধ্যায়

স্মৃতিবাসর 


স্মৃতিকথারা ডাক দিলে পর্ণ কুটিরেও চাঁদ ওঠে

একটা পানসি ভেসে যায় দারিয়াপুর

জলের সাথে তার আজন্ম গল্প বলা অফুরান

শালুকের ঝাঁক মুচকি হেসে তাকে চুমু খায়


ভিতর ঘরে শ্রাবণ এলেই স্মৃতিকথারা সরব

নিকোনো দুয়ারে পা ছড়িয়ে গল্পে মাতে

আম কাসুন্দি আর নারকেল মাখা মুড়িতে

জিভের লালায় কতো পথ জাগে


স্মৃতিকথাদের নকশি কাঁথায় বুনলেই একটা আস্ত জীবন

ফেলে আসা বটের ছায়া

ফেলে আসা পুকুর ঘাট

ফিরে আসার ধারা স্রোতে ভাসতে থাকে সুখ চারণ... 





রুষা

শেষ ট্রেন

শেষ ট্রেনের হুইসেল রাত কে বিদায় জানায়...

মিশে থাকে বিষন্নতা,

শেষ ট্রেনের যাত্রীরা বিষন্নতার একেকটি পাতা।

পসরার বোঝা ধকল মেখে চলেছে অনন্ত বিশ্রামের পথে...

তারা ঘরে ফিরছে।

শুধু বাতাসে প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে,

যারা আজ ফিরছে...

তারা কি কাল ও ফিরবে?...


নিষিদ্ধ

সম্পর্কের সংজ্ঞা থাকে...

সংজ্ঞা অনুযায়ী চলতে হয়।

নিষিদ্ধ মানব মানবী ধোঁয়া হয়ে উড়ে যায়।...

ছিঃ!

উন্মাদ তকমা

নিয়ম মেনে চলো।


নক্রচরিত

পৃথিবীর একটা দিকে পচন ধরছে

পচন ছড়িয়ে দিচ্ছে...

দিনশেষে ব্যর্থ জোকারের প্রতিচ্ছবি।

রং মাখো

খুশি থাকো

সান্ত্বনা পাও যে যার মতন।

হা নক্র!





গুচ্ছ কবিতা।।তৈমুর খান ।।

সমস্ত যুদ্ধের পর   অনেক মৃত্যুর পর এই বেঁচে থাকা  হেসে ওঠে মাঝরাতে  কোনও পিয়ানোর সুরে  খোলাচুল উড়ে আসে তার  বুকের ভেতর থেকে জ্যোৎস্নার ফণা ...