কবি চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্য্য।
কাব্যগ্রন্থ "রাত্রির দিনলিপি"
সাঁঝবাতি প্রকাশন
রাতের পিছনে আসে দিন। আবার অস্তরাগের পরে কালো আঁধার রাত। এইভাবে রোদ ও রাতের যাপন ধরা থাকে অক্ষর বিন্যাসে। আর যদি কবি হন ঋষি মনের, প্রেমিক ভাবের আর চির নবীন, তাহলে রোদ ও রাতের রঙে তাঁর নির্মোহ আবেগ দিয়ে তিনি রাঙিয়ে দেন দৈনন্দিন জীবনের চাওয়া পাওয়ার দুর্লভ মুহূর্তগুলিকে। সমগ্র জীবন তখন কবিতার অক্ষরে অক্ষরে হয়ে যায় ভুবন ডাঙার মাঠ। ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা কবি তখন দেখতে পান,,,, ভুবনডাঙার মাঠে সেই "বট গাছটার দেহাতী ছায়া / মোড়লের বৌ-এর মতো ঘোমটা টেনে / কোনো এক রবিঠাকুরের জন্যে / রোদটাকে পাহারা দিচ্ছে"...
আছে চির নবীন কবি, চির প্রেমিক ঋষি কবি চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্য্য তাঁর "রাত্রির দিনলিপি" কাব্যগ্রন্থে প্রথম কবিতাতেই এইভাবে লিখেছেন আলোবেলার কথা। লিখতে ভুলেননি আলো ছায়ার কথাও। কবি এই কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেছেন তাঁর অমৃতলোকবাসী পিতা মাতাকে। কেননা তাঁর মনে সদা জেগে আছে,
"কুলুঙ্গিতে পড়ে রইল অন্নদামঙ্গল/ আর আমার মায়ের রেখে যাওয়া ধৌত অঙ্গবাস।"
পড়াশোনা এবং কবিতা চর্চা আজও আশি উত্তীর্ণ কবির দিনযাপনের সঙ্গী। প্রকৃত অর্থে তিনি কবিতা সাধক। কবিতাই তাঁর ঘর সংসার। কবিতা তাঁর ঈশ্বর সাধনা। তাই তো অনায়াসে তিনি লিখতে পারেন,,
" ঈশ্বরও এসে পাশে বসেন/ তিনিও স্মৃতির মধ্যে বাস করেন এখন/এবং ঈশ্বরীর সঙ্গে চলে যাওয়া ব্রহ্মকমল দিনগুলি/ তাঁর এমন একটি প্রিয় বিষয়।"
কবির ব্যক্তিগত সহজ সরল অনাড়ম্বর জীবন। তাঁর মধ্যেই তিনি উপলব্ধি করতে পারেন,,,
"ব্যক্তিগত বনবাস পার হয়ে
দৈবাৎ উঠোনে এসে রেলগাড়ি পেয়ে যায় দূরের ফেরিঘাট।"
কবি হলেন চির প্রেমিক। চির সবুজ একটি মন চিরস্থায়ী তাঁর অন্তরে। প্রেম ও প্রকৃতিকে তিনি এক সুতোয় বাঁধতে জানেন। "তোমার সঙ্গে তৈরি করব গোপন খেলাঘর/গান নদী সাঁকো পাখি সাজাব পরপর।"
তিনি তাঁর মানস প্রতিমার কাছে নিরালায় মুখোমুখি,,, "ডুবে যাবার আগে বলুন না কেমন আছেন/
কেন বলতে পারছেন না-''আপনি যেমন রেখেছেন।''
নদী নারী ও নীরবতা কবির সাধনার অন্যতম বিষয়। নারী তাঁর কাছে এসেছে বিভিন্ন রূপে। নারী চরিত্র তিনি এঁকেছেন গভীর অনুভবে।
" কুয়াশার কাছে ঋণী ছিল খেয়া নৌকার ক্ষণপ্রভা নারী/ নারীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকল চিরকালের আদিত্যপুরুষ।"
"ঝুমুর" কবিতায় তাঁর নারী ও নদীর চিত্রকল্প আমার মতো আনাড়ি পাঠককেও ভাবায় দুদণ্ড। "দেখি বুকের গভীরে নারী চিত্রবহ নদী হয়ে আছে।"
জীবনানন্দ দাশকে স্মরণে রেখে কবি তাঁর কাব্য প্রতিমার জন্যে মনোবেদনার কথা লেখেন, ইলা ও নদীর কথা বলেন। "ইলার কাছেই কবি শব্দ আর কোলাহলের তফাৎ শিখেছেন.... ইলা চলে গেছে পশ্চিম বাহিনী কোন নদীর কাছে।/ কার হাতের উপর হাত রেখে কবি এখন/ দুঃখহরণ শব্দগুলিকে অমৃত যন্ত্রণায়
নিবেদন করবেন।"
নারী তাঁর কাছে পরম ভরসা আর বিশ্বাসের আশ্রয়স্থল। আমি আমার মতো করে খুঁজে পেয়েছি কবির সেই লিপিমালা।
"কথা ছিল ঝড় ঝাপটা সামলে দেবে মৌরীফুলের সারি/ শ্রাবণ এলে ধান পুঁতবে বৃষ্টিধোয়া রাজেশ্বরী নারী।"
" সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে দেখা গেল পাহাড় গেছে বনে/ ভাঙা ঘরে ফিরে এসে পুরুষ দেখে নদীও নির্বাসনে।"
"নদী হল সন্ন্যাসিনী /পাহাড় হল ফকির/ শুকনো ডাঙায় ঘর ভেঙে যায়/পর্যটক কবির।"
তিনি জানেন প্রেম চলে গেলে, নারী চলে গেলে পুরুষ জীবনে শূন্যতা আসে। সেই শূন্যতার ছবি তিনি শূন্যতার রঙে এঁকেছেন।
"এমন করে চলে গেলে তুমি শূন্যতাও শূন্য হয়ে যাবে।"
তিনি তাঁর অনুভব ক্ষমতার জোরে নারী মনটিকেও অনুভবে আনেন। "আয় ঠাকুরঝি দোর খুলে দি আঁচল খুলে রাখ।/ জলের বসন পর গো সখী আঁধার গায়ে মাখ।"
ঘর গেরস্থালি আর ঘরের মানুষজন তাঁর কবিতায় প্রাণ পায় এভাবেই।
"ছেলে কোলে মায়েদের ভগ্ন কণ্ঠস্বর/ অন্ধকারে চেয়ে আছে ঈশ্বরের অসুস্থ সংবাদে।"
"এখন কথাবার্তা সব বন্ধ/ জানলায় আর কোনো রূপচর্চা নেই... আমাদের এখন ক্লান্তির কাল।"
তিনি আবার কালে উত্তীর্ণ করেছেন তাঁর মন ও মনন শিল্পকে। তিনি শুধু প্রেমিক নন, নদী নারী নীরবতার পরেও তিনি পথ খুঁজেন নিজের জন্যে, পথ খুঁজে দেন আমাদের জন্যে। এটাই তাঁর সৃষ্টির সার্থকতা।
"উদাসীন চোখে কোনো বিকার থাকে না
দার্শনিক হয়ে যাওয়া বড়ই সহজ।"
" চল আমরা যাই সাঁকো পেরিয়ে অজ্ঞাতবাসের ঠিকানায় ,,,দিনের আলো থাকতে থাকতে যে যার প্রিয় জিনিসগুলি/ নারী প্রেম বিবাহের মন্ত্র সন্তানের স্বপ্ন এবং মায়ের ডাক/ নদীর বুকের ভাষা/ পার্শ্ববর্তী শমীবৃক্ষে তুলে রেখে দিয়ে যাই।"
"শিউলিগন্ধে শোকপ্রস্তাব মনের মধ্যে আসুক/ শরীর জুড়ে উথাল পাতাল নীরবতা ভাসুক।
"এক তরুণ কবি এবং মৈত্রেয়ী" "মধ্যরাতে বধ্যভূমি" "চায়ের ভাঁড় এবং পায়ের চটি" মুক্ত গদ্য কিম্বা বিশুদ্ধ কবিতায় সেই উচ্চারণ ভিন্ন রূপ ও রসে আমাকে বিমোহিত করেছে।
কবির চিত্রকল্প , অনুভব ক্ষমতা, দর্শন বোধ আমাকে মুগ্ধ করে। বিস্মিত করে। ইতিহাস, পুরাণ তাঁর গভীর জ্ঞান ও প্রকাশে অন্য মাত্রা পেয়েছে তাঁর কবিতায়,,,
"পায়ে ফণী মনসার ঝোপ নিয়ে শুধু এক তালগাছ দাঁড়িয়ে একটি টিলায়/ যেন আটলান্টিকে নোঙর ফেলা সাও গ্যাব্রিয়েল।" "ক্লিয়োপেট্রা নাটকে নায়িকার ভূমিকায় যোগ্য অভিনেত্রী না পাওয়ায় স্বয়ং ক্লিয়োপেট্রাই অবতীর্ণ- তাঁর কোন মেক আপ লাগছে না।"
তাঁর প্রতিটি কবিতার প্রতিটি লাইন এক একটি পূর্ণাঙ্গ কবিতা। প্রতিটি চিত্রকল্প জীবন্ত, প্রাণময়।
"চর্যাপদের হরিণীদের মেঘে ঢাকা ঘাস বিলি হয়ে যায় প্রকাশ্য দোকানে,,, মহাজনী খাতার লেনদেন কালান্তরে বদলে যায় কালিন্দী ও গিরিগোবর্ধন।"
"শঙ্খ বণিকের পালা" কবিতায় তিনি লিখেছেন অভিনব অনুভূতি। "ভোরের আলোয় পুষ্করিণীর জলে ভেসে উঠবে শাঁখা পরা হাত/ হাতে লেগে থাকবে কনকচূড়া ধানের গন্ধ আর আসতো ধাতুর লাবণ্য।"
নিরাশায় তাঁর বাস নয়। তাঁর নির্মাণে আমরা আশার আলো, বাঁচার আলো ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পাই।
"সময় হলে পৃথিবীতে গ্রহণমুক্তির আলো এসে পৌঁছাবে/ ততদিন কেউ না কেউ থাকবে জেগে থাকবে।"
"অসুখ বিসুখ হলে সাদা কাগজে/সাম্রাজ্যের মানচিত্র এঁকে নিও/ কিন্তু সীমানা নির্দেশ করো না।"
অবশেষে এই প্রেমিক কবি কতো অক্লেশে লিখতে পারেন ,,,
"আমার নিজের বলতে আছে বৃষ্টির দিনগুলি/আর উদাসীন শরীরটুকু/ অন্য যা ছিল তা দখল করে নিয়ে গেছে/ অন্য এক হরিণী।"
শ্রদ্ধায় নত হই, মুগ্ধতায় বিস্মিত হই, আর দিনের সমস্ত না পাওয়া ভুলে যাই কবির এই কাব্যগ্রন্থের লাইনগুলি ছুঁয়ে।
No comments:
Post a Comment